নসরুল হামিদের ১০০ ডলারের শেল কোম্পানি যেভাবে ৩০ কোটি ডলারের এলপিজি প্রকল্পের চুক্তি বাগিয়ে নেয়
সরকারি দায়িত্বশীল পদে থেকেও এর পরিপন্থী কাজ করে কীভাবে সিঙ্গাপুরে নিজের মামার নামে একটি শেল কোম্পানি খুলেছিলেন সাবেক বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, এবং সেই কোম্পানিসহ আরও দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান – সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ভিটোল ও জাপানের মারুবেনি কর্পোরেশনকে – ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের এলপিজি টার্মিনাল চুক্তির জন্য নির্বাচন করেছিলেন— এই কাহিনি তা নিয়েই।
২০২১ সালের মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন – ভিটোল, মারুবেনি কর্পোরেশন এবং সিঙ্গাপুরে নিবন্ধন নেওয়া বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পাওয়াকো ইন্টারন্যাশনাল – এই তিনটি কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়াম বা যৌথ ব্যবসায়িক জোটের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে।
অর্থপাচার ও নানান ধরনের দুর্নীতির জন্য খোলা হয় শেল বা গোপন কোম্পানি। করফাঁকি এবং আয়ের উৎস গোপন করতে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা করস্বর্গ বলে পরিচিত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এসব প্রতিষ্ঠান খুলে থাকে। পাওয়ারকো-ও আসলে একটি শেল কোম্পানি, যার পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার, এর সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুলের। কনসোর্টিয়ামের অপর দুই অংশীদার ভিটোল ও মারুবেনি-ও আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান, চুক্তি সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ প্রদানের জন্য – মার্কিন বিচার বিভাগ উভয় সংস্থাকে বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করেছে।
সমঝোতা স্মারকে বলা হয়, এই তিন কোম্পানির কনসোর্টিয়াম বিল্ড (নির্মাণ), ওন (মালিকানা), অপারেট (পরিচালনা) ও ট্রান্সফার (হস্তান্তর) বা (BOOT) মডেলের আওতায় ৩০৫ মিলিয়ন (৩০ কোটি ৫০ লাখ) ডলারে একটি মিলিয়ন টন সক্ষমতার এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে।
সেইমতো ২০২২-২৩ সময়ে এক প্রকল্প পরামর্শক নিয়োগে সরকার ৬ কোটি টাকাও ব্যয় করে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বিপিসি ওই পরামর্শককে নিয়োগ দেয়নি এবং সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন-ও চালু করতে পারেনি।
বিপিসি ওই সমঝোতায় সইয়ের এক মাস আগে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। যার শিরোনাম ছিল– "হান্ড্রেড ডলার কোম্পানি, ডিসপিউটেড ভিটোল চুজেন ফর লারজেস্ট এলপিজি টার্মিনাল।"
প্রতিবেদনে সরাসরি নসরুল হামিদের নাম উল্লেখ করা না হলেও– প্রতিবেদনটি আমাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য তিনি তাৎক্ষনিকভাবে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকী প্রতিবেদককে 'শিবির কর্মী' বলে তাঁকে হয়রানিও করেন।
২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ
প্রতিবেদনে বলা হয়, "এপর্যন্ত দেশের বৃহত্তম ডিপ-সি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) টার্মিনাল নির্মাণের কাজ তিনটি কোম্পানির এক কনসোর্টিয়ামকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), যাদের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের পটভূমি প্রশ্নবিদ্ধ।
"মহেশখালীতে মিলিয়ন টন ক্ষমতা সম্পন্ন এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি পাওয়া কনসোর্টিয়ামের অংশীদার সুইস ট্রেডিং ফার্ম ভিটোলকে গত ডিসেম্বরে (২০২০ সালের) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রকরা ব্রাজিলের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার জন্য ১৬৪ মিলিয়ন (১৬ কোটি ৪০ লাখ) ডলার জরিমানা করেছে।
কনসোর্টিয়ামের বাংলাদেশী শেয়ারধারী পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটির অধীনে (এসিআরএ) তালিকাভুক্ত, যার পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার। এই কনসোর্টিয়ামের অন্য কোম্পানিটি হচ্ছে জাপানের মারুবেনি কর্পোরেশন।"
ভিটোল-মারুবেনি-পাওয়ারকো'র কনসোর্টিয়াম মহেশখালীতে ৩০৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে, এবং প্রকল্পের জন্য ৪৭ একর জমি দেওয়ার বিনিময়ে বিপিসিকে ৩০ শতাংশ শেয়ার দেবে।
ভিটোলের বিতর্কিত ভাবমূর্তির কথা বাদেও — এই ঘটনার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি ছিল বাংলাদেশী কোম্পানি পাওয়ারকো নিয়ে। ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট পাওয়ারকো গঠিত হয়, এবং এর শেয়ারধারী হিসেবে ছিলেন মো. কামরুজ্জমান চৌধুরী ও নাবিল খান। কামরুজ্জমান নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় (আপন মামা) এবং নাবিল তার বন্ধু।
পাওয়ারকো'র সাথে যেভাবে সম্পৃক্ত নসরুল
টিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়: পাওয়ারকো তার পোর্টফোলিওতে ঢাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে একটি শীর্ষস্থানীয় প্রকল্প উন্নয়ন ও বাণিজ্য সংস্থা হিসাবে নিজ পরিচয় দিয়েছে, যাদের সিঙ্গাপুরে অফিস রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়িক স্বত্বা, পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও বাণিজ্যিক সেবাদাতাদের জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা- এসিআরএ'তে তালিকাভুক্তির সময়ে কোম্পানিটি জানিয়েছিল যে, তাদের মূল কর্মকাণ্ড হচ্ছে ব্যবস্থাপনার পরামর্শক সেবাপ্রদান ও বিভিন্ন ধরনের পাইকারি পণ্যের বাণিজ্য।
এসিআরএ'র কাছে পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার দেখায় পাওয়ারকো।
এলপিজি টার্মিনালটির প্রকল্প প্রস্তাবে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে ভিটোল ও পাওয়ারকো ৩০ শতাংশ করে শেয়ারধারণের ইচ্ছেপ্রকাশ করেছে, যার অর্থ তাদের প্রত্যেককে ৪৫ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার করে ব্যয় বহন করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলেছেন, ব্যয় নির্বাহে অংশ নেওয়া ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই কনসোর্টিয়ামের শেয়ারধারী হতে পারে না। এমতাবস্থায়, মাত্র ১০০ ডলারের পরিশোধিত মূলধনের একটি কোম্পানি কীভাবে ৪৫ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে– সেই প্রশ্ন রাখেন তারা।
টিবিএসের প্রতিবেদক রাজধানীর বনানীতে পাওয়ারকো'র হেড অফিসে গিয়ে সেখানে রিসিপশনিস্টসহ মাত্র তিন জন কর্মীকে দেখেন।
তাঁদের কাছে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের বিষয়ে জানতে চাইলে, তারা কেউই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের নাম বলতে পারেননি। তবে তারা কোম্পানির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এম মুরাদ হাসানের সাথে যোগাযোগের নম্বর দেন।
যোগাযোগ করলে, মুরাদ হাসান টিবিএসকে বলেন, তিনি বিপিসির সিদ্ধান্তের কথা জানেন না।
কনসোর্টিয়ামে তাদের কোম্পানির শেয়ার বা বিনিয়োগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, তিনি এবিষয়ে মন্তব্য করতে আরও সময় চান। অবশ্য তিনিও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম বলতে পারেননি।
ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে, টিবিএস কিছু তথ্য প্রকাশও করতে পারেনি।
যেমন আরও অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাওয়ারকো'র পাশাপাশি ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিরও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মুরাদ হাসান, যেটি হামিদ গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
নথিপত্র অনুযায়ী, এক সময় ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন নসরুল হামিদ। পরে তার ছোট ভাই ও ছেলেকে কোম্পানির শীর্ষ পদগুলোতে বসানো হয়।
এভাবে হামিদ গ্রুপ ও নসরুল হামিদের সাথে পাওয়ারকো'র সংযোগ খুঁজে পাওয়ার পরে টিবিএস আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখে, কামরুজ্জামান চৌধুরী হলেন নসরুলের মামা। আসলে তাকে সামনে রেখে কোম্পানিটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করতেন নসরুল হামিদ।
টিবিএসের প্রতিবেদন প্রকাশের পর যখন চাপ দিয়ে সেটিকে ওয়েবসাইট সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করা হয়– এরপরে এনিয়ে আরও অনুসন্ধান করে নেত্রনিউজ। নসরুল হামিদের মামা কামরুজ্জামানের সাথে কথা বলে নেত্রনিউজ, যা রেকর্ড করা হয়। সেখানে কামরুজ্জামানকে বলেছেন যে, কাগজেকলমে তিনিই যে কোম্পানির মালিক– তার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেন না তিনি, কেবল তার ভাগ্নেদের কথামতো কোম্পানি নিবন্ধনের কাগজপত্রে সইসাবুদ করেছেন।
তাঁকে উদ্ধৃত করে নেত্রনিউজের সংবাদে বলা হয়, "ওরা তো আমার আত্মীয় তো। আপন মামা তো আমি। নিয়া বলছে যে এখানে এখানে সই করো। আমি সই করছি। আমি তেমন ভালো কইরা পড়িও নাই কী লেখা আছে।"
তবে তিনি দাবি করেন কোম্পানিটির সাথে তার আর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তার ভাষ্য, "আমি অত ডিটেইলস কোনো কিছুই জানি না। আসলে আমি কোনো কিছুই জানি না। আমাকে শুধু বলা হইছে যে ইউ হ্যাভ সাম শেয়ারস ইন দিস কোম্পানি — এখানে এখানে সই করো। আমি করছি। আবার এক সময় বলছে যে, না, তোমার শেয়ার আর নাই, এখানে এখানে সই করো। আমি কইরা দিছি। এই পর্যন্তই। এর আগে পরের সামনের পিছনে আমি আর ডিটেইলস কোনো কিছুই জানি না।"
মুরাদ হাসানের মাধ্যমেও পাওয়ারকো'র সাথে আরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে নসরুল হামিদের। সিঙ্গাপুরে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের একজন বিকল্প পরিচালক হলেন মুরাদ হাসান। এই মুরাদ হাসানই আবার "ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট" নামে হামিদ গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও ছিলেন।
পাওয়ারকো'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাবিল খান একজন ভারতীয় নাগরিক, তিনি দুবাই-ভিত্তিক একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান অ্যাসসেন্টিস ক্যাপিটাল পরিচালনা করেন। নসরুল হামিদের ছোট ভাই এন্থেখাবুল হামিদের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলেন নাবিল খান।
নাবিল সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিট্রেক শিপিং কোম্পানির মধ্যপ্রাচ্য শাখারও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যেটি চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিপিং লাইনের সহযোগী সংস্থা।