চট্টগ্রামে হোটেল বুকিং কমেছে, ১৫ দিনে লোকসান হাজার কোটি টাকা
পাঁচতারকা মানের রেডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বে ভিউ হোটেলে স্বাভাবিক সময়ে জুলাই-আগস্ট মাসে ২৪১ রুম ক্যাপাসিটির প্রায় ৭০ শতাংশ বুকিং থাকে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে চলমান অস্থিরতায় এখন সেই বুকিং নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নিচে।
শুধু তাই নয়, জুলাই এবং আগস্টে দেশি–বিদেশি অথিতিদের অগ্রিম বুকিংও প্রত্যাহার হয়ে গেছে ৫০ শতাংশের বেশি। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় নতুন কোনো বুকিং আসেনি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
রেডিসন ব্লু হোটেলের মতো চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ তিন পার্বত্য অঞ্চলের হোটেল মোটেলগুলোর অবস্থা একই। জুলাই থেকে ব্যবসার পিক সিজন শুরু হওয়ার প্রথমেই বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন সবাই।
হোটেল মালিকরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতি করোনাকালকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত ১৫ দিনে এই ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এর আগে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০২৩ সালের শেষ দিকে দেশের হোটেল তথা টুরিজম খাতের ব্যবসায় ধস নেমেছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত ছিল এই সংকট। সারাদেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোতে গড়ে ৮০% পর্যন্ত অগ্রিম বুকিং বাতিল হয়ে যায় পর্যটনের ভরা মৌসুমে।
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এবারের পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের পাশাপাশি পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ সবক্ষেত্রেই একই অবস্থা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, তারকা হোটেলগুলোতে অতিথি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি। এসব হোটেলে সেমিনার ও ওয়ার্কশপের মতো করপোরেট ইভেন্টগুলোও এখন বন্ধ রয়েছে।
রেডিসন ব্লু হোটেলের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক ফয়সাল কবির টিবিএসকে বলেন, "চলমান অস্থিরতার কারণে ফরেন ট্রাভেল কমে গেছে। গার্মেন্টস এর বায়ার, বিদেশি প্রকল্প, দুতাবাস, এনজিও সেক্টরের লোকজনের ট্রাভেল ছিল, সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে। আগে থেকে যেসব বুকিং ছিল সেগুলোও বাতিল হয়ে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে আমাদের অনলাইনে বুকিং বন্ধ হয়ে যায়। ফরেন কাস্টমারদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।"
চট্টগ্রামের তারকামানের হোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, করোনাকালের মতো ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের তারকা হোটেল শিল্প। বর্তমানে তারকা হোটেলগুলো প্রায় অতিথিশূন্য হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এ সময়ে হোটেলগুলোর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অতিথি পূর্ণ থাকে। বিভিন্ন তারকা হোটেলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি কিছু অতিথি দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান করেন। তারাও আতঙ্কে আছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে হোটেলগুলো একেবারে অতিথিশূন্য হয়ে পড়বে।
এদিকে, কক্সবাজার হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নুরুল করিম বলেন, "কক্সবাজারে ছোট বড় মিলিয়ে ৫ শতাধিক হোটেল-মেটেল রয়েছে। এসব হোটেলে কাজ করেন কয়েক হাজার কর্মী। গত ১৫ দিন ধরে সবাই বেকার বসে আছেন। দেশের পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। এমন অবস্থায় হোটেল মালিকরা পথে বসে যাওয়ার উপক্রম।"
"গত ১৫ দিনে এই ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে," জানান তিনি।
বিআইএইচএ এর নির্বাহী সদস্য কক্সবাজারের হোটেল দ্য কক্স টুডে'র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "কক্সবাজারের সব ধরনের হোটেল মোটেলগুলোর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। হোটেলের বুকিং প্রায় বন্ধ। কিছু কিছু হোটেলে ৫ থেকে ৬টি রুমের বুকিং আছে। আমাদের দ্য কক্স টুডে'র ২৭০টি রুমের বুকিং অবস্থাও একই। এমন পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের হোটেলগুলো টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।"
চট্টগ্রামের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র ফয়েস লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক অ্যান্ড রিসোর্ট। এখানে প্রায় ৫০ সিট ক্যাপাসিটির রিসোর্ট এবং বাংলো রয়েছে। কাজ করে প্রায় ২৭০ জন কর্মী। রিসোর্টের রুম প্রায় বুকিং শূন্য। বাতিল হয়ে গেছে বিভিন্ন কোম্পানির কনফারেন্স শিডিউল। এমন অবস্থায় পার্কটির দৈনিক খরচও উঠে আসছে না।
ফয়েসলেক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক এর মার্কেটিং ম্যানেজার বিশ্বজিত ঘোষ বলেন, "করোনা পরিস্থিতির মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে পুরো পার্ক। এমন অবস্থায় মেনটেইনেন্স খরচও উঠে আসছে না।"
এদিকে, পার্বত্য উপজেলাগুলোও প্রায় পর্যটক শূন্য। অতিথিশূন্য হয়ে পড়েছে পার্বত্য উপজেলার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের হোটেল মোটেলগুলো। লোকসান কমাতে হেটেলের কর্মীদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই এসব হোটেলের লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।
রাঙ্গামাটি শহরের হোটেল সাংহাই ইন্টারন্যাশাল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল আলম বলেন, "গত ১৫ দিন ধরে হোটেলের বুকিং নেই। হোটেলটি ভাড়া নিয়ে চালাই। কর্মীদের বেতন, হোটেল ভাড়াসহ এ পর্যন্ত দুই লাখ টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে জানি না।"
এ ধরনের সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ে এর আগে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হলেও কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল মালিকরা কোনোরকম সারকারি সহায়তা পায়নি। চলমান অস্থিরতা দূর করতে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক হওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।