২০৪১ সাল নাগাদ যোগাযোগ সম্প্রসারণে ১২ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা
বিস্তৃত একটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃসীমান্ত সংযোগ স্থাপনের জন্য ১২টি এক্সপ্রেসওয়ে রুটের মাধ্যমে দেশের সড়ক নেটওয়ার্ককে আন্তঃসংযুক্ত করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে একটি সড়ক মহাপরিকল্পনা (হাইওয়ে মাস্টারপ্ল্যান) তৈরির কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তর।
এসব এক্সেপ্রেসওয়ে নির্মাণে মোট ১ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা (১৭.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে; এবং এর আওতায় মোট ১,৫০৭.৮ কিলোমিটার মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান বলেন, এই মহাপরিকল্পনায় দেশের সব মহাসড়ককে একক নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে, যা প্রথাগত সড়ক নেটওয়ার্কের বাইরে হবে।
'হাইওয়ে মাস্টার প্ল্যান ২০৪১' শীর্ষক এ মহাপরিকল্পনার খসড়া তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, আগামী বছরের প্রথমার্ধে খসড়া পরিকল্পনাটি অনুমোদিত হওয়ার পরে বাস্তবায়নের জন্য কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হবে।
ওই কর্মকর্তা জানান, ১২টি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের এই পরিকল্পনা হবে ১০-১২ বছর মেয়াদি, যা বাস্তবায়নে বছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের তহবিল লাগবে। নির্মাণ কাজের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি)-কে অগ্রাধিকার দেবে সরকার। অর্থায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ।
এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কিছু উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু, খরচ এবং দ্রুতগতির ট্রেন চালুর কথা বলে পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে ফেরত আসে। তার পরিবর্তে, প্রচলিত সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্যিক মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হয়।
রাজধানীকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করা ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে বর্তমানে দেশের একমাত্র প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত (অ্যাক্সেস-কন্ট্রোল) এক্সপ্রেসওয়ে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলো সড়কের এই ধরনের মাস্টারপ্ল্যান ৮০/৯০ এর দশকে বাস্তবায়ন করেছে। আগে যত সহজে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা যেত– তা এখন বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জ হবে। তবু দেশের ক্রমাগত বিকাশ ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে এগুলো নির্মাণ করতে হবে।
প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ে:
'হাইওয়ে মাস্টার প্ল্যান ২০৪১' শীর্ষক খসড়া মহাপরিকল্পনায় যে ১২টি এক্সেপ্রেসওয়েকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে– ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-চট্টগ্রাম (উড়াল), ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা আউটার রিং রোড, ঢাকা-বগুড়া, (বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে) মিরসরাই-কক্সবাজার, ময়মনসিংহ-বগুড়া, গাবতলী-পাটুরিয়া (বিদ্যমান সড়ক উন্নতকরণ) থেকে কাজীরহাট, ফেনী-বরিশাল, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া- দাশুরিয়া।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মোহাম্মদ ইউনূস টিবিএসকে বলেন, উন্নত দেশ হতে হলে বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, 'প্রত্যেক দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের একটি মাস্টার প্ল্যান থাকে। দীর্ঘমেয়াদে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়িত হবে সড়কের এই মহাপরিকল্পনা। ফলে অর্থায়ন নিয়ে খুব একটা চাপ তৈরি হবে না।'
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এখন বড় প্রকল্প নেওয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে ইউনূস আরও বলেন, 'পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু, মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে রাখা দরকার, যাতে তহবিল পাওয়ার সাথে সাথেই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করা যায়।'
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, মহাসড়কের মাস্টার প্ল্যান থাকা জরুরি। তবে সড়কের পাশাপাশি রেল, গ্রামীণ সড়ক ও নৌ– সব ধরণের যোগাযোগ অবকাঠামোর জন্য সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান থাকা প্রয়োজন। 'পরিকল্পনা কমিশন থেকে সমন্বিত যোগাযোগ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কথা ভাবাও হচ্ছে।'
প্রথাগত সড়ক নির্মাণের বাইরে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনাকে যৌক্তিক উল্লেখ করে– একে সাধুবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক।
তিনি বলেন, 'মান্ধাতার আমলের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আমরা সড়ক প্রশস্ত করে ৮/ ১০ লেনের উন্নয়ন করছি। যেখানে নিরাপত্তা নেই, প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ (অ্যাক্সেস কন্ট্রোল) নেই, অবাধে সেখানে রিক্সা চলাচল করে। এটা একটা ভুল নীতি। প্রথাগত এই উন্নয়নে সময় ও সম্পদ নষ্ট হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের ভূমি কম, জনসংখ্যা বেশি, এ কারণে আমাদের এলিভেটেড ওয়েতে চলে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করতে হবে । এতে বাড়তি জায়গা ছাড়াই একই ভূমির বহুমাত্রিক ব্যবহার হবে। সিঙ্গাপুর ও হংকং সফলভাবে এই মডেল বাস্তবায়ন করেছে। 'এটা খরচের বিষয় না, এটা কৌশলের বিষয়। কৌশলগত উন্নয়নই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি।'
অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ শক্তিশালী করা ছাড়াও– সীমান্ত এলাকাজুড়ে ভ্যালু চেইনের বিকাশের সুবাদে – আন্তঃসীমান্ত পণ্য প্রবাহে প্রায় ৩৫০ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে সড়কের এই মহাপরিকল্পনায়।
সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, প্রস্তাবিত মাস্টার প্ল্যানটি দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) এ দেশের সমুদ্র ও স্থল বন্দরগুলোকে প্রধান সীমান্ত পয়েন্টের সাথে সংযুক্ত করতে নির্ধারিত একাধিক মহাসড়ক বিবেচনা করবে।
ইতোমধ্যেই সম্পন্ন বা নির্মাণাধীন বেশ কয়েকটি সাসেক মহাসড়কের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, সিলেট-তামাবিল এবং কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর।
আগের পরিকল্পনাগুলো থেকে এর ভিন্নতা যেখানে
সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, ঢাকা থেকে লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সমীক্ষা হয় ২০১৮ সালে। একইসঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের একটি নকশাও প্রণয়ন করা হয়। এডিবির সমীক্ষা অনুযায়ী, ২১৭ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ সেতু কতৃপক্ষ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ২২৫ কিলোমিটারের একটি উড়াল এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তবে নির্মাণ খরচ বেশি এবং দ্রুত গতি ট্রেন চালুর সম্ভাবনা নিয়ে সরকারের পরবর্তী সময়ের চিন্তাভাবনার ফলে এসব উদ্যোগের কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি।
সড়ক পরিবহন ও জনপথ অধিদপ্তর বুয়েট বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে দেশের উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিমে একটি এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছিল। তবে অর্থায়ন বিবেচনায় ২০২১ সালে এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, নতুন মহাপরিকল্পনাটি আগেরটির চেয়ে আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক, কারণে এতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগকেও রাখা হয়েছে।