হরতাল-অবরোধের প্রভাব: ট্রাক সংকটে বোরো মৌসুমে সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কা
টানা হরতাল-অবরোধে সার সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সীমিত ট্রাক চলাচলের কারণে সারাদেশে গুদামগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে সার সরবরাহ করতে পারছে না। এতে করে বোরো মৌসুমের 'পিক সিজনে' চাহিদা অনুযায়ী সার সরবরাহে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয় ও সারাদেশে ডিসি-এসপিদের আলাদা আলাদা চিঠি দিয়েছে। হরতাল-অবরোধে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয় সেখানে।
জানা যায়, ডিসেম্বর থেকে বোরো মৌসুমের পিক সিজন। উপকরণ নির্ভর ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় এই মৌসুমে সারের প্রয়োজনও বেশি। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ইউরিয়া সারের চাহিদা থাকে প্রায় ১৭ লাখ টন। সরবরাহ চেইনে থাকা সার সারাদেশে নির্ধারিত সময়ে বিতরণ করতে না পারলে সংকটের আশংকা তৈরি হবে।
বোরো মৌসুমে ২ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়, যা দেশের সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়।
পরিবহন ঠিকাদাররা বলছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দৈনিক যে পরিমাণ সারের প্রয়োজন সে পরিমাণ সার গুদামে সরবরাহ করা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সার পরিবহনের জন্য প্রয়োজনমাফিক ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। স্বল্পসংখ্যক ট্রাক পাওয়া গেলেও গুদামে নিরাপদে সার পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিসিআইসির গত ১০ নভেম্বরের 'ইউরিয়া সারের দৈনিক বিবৃতি'র তথ্যে দেখা যায়, এদিন সারাদেশের গুদামগুলোতে ৪৬১২ মে. টন সার প্রবেশ করেছে। কিন্তু গুদামগুলো থেকে ডিলার পর্যায়ে সার ডেলিভারি করা হয়েছে ৯২৯৬ মে. টন।
বিসিআইসির পরিসংখ্যান বলছে, পিক সিজনে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হতে ২০ হাজার মে. টন সার গুদামসমূহে সরবরাহ করা হয়েছে। এতে প্রায় ৯০০-১০০০টি ট্রাক প্রয়োজন হয়। হরতাল-অবরোধের কারণে সার পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক পাওয়া না গেলে পিক সিজনে দেশের বাফার গুদামে সারের ঘাটতির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে দেশে বিরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।
কাফকো সার-কারখানা থেকে উত্তরাঞ্চলে ইউরিয়া সার সরবরাহের পরিবহন ঠিকাদারির কাজ করছেন রুহুল আমীন। পিক সিজনে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিনই ২০-৫০টি পর্যন্ত ট্রাক চলাচল করার কথা। প্রতিটি ট্রাকে ১৫-২০ টন করে সার পরিবহন করা হয়। কিন্তু তিনি ট্রাক সংকটে স্বাভাবিকভাবে সার পরিবহন করতে পারছেন না। একদিকে ট্রাক পাচ্ছেন না, অন্যদিকে গুটিকয়েক ট্রাক পেলেও তার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
রুহুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "হরতাল-অবরোধে ট্রাক পুড়িয়ে ফেলার ভয়ে মালিকরা ট্রাক বের করছে না। এজন্য সার পরিবহনে জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেদিন আমার ২০টা ট্রাক দরকার, সেদিন হয়তো ১০টা ট্রাক যোগাড় করাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে।"
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে লাইটার জাহাজে খুলনা, যশোরের নওয়াপাড়া, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী ও আশুগঞ্জ নৌ বন্দরে পরিবহন করা হয়। এসব ঘাট থেকে পরিবহন ঠিকাদাররা ট্রাকযোগে দেশের ৩০টি বাফার গুদামে সার পরিবহন করেন।
অন্যদিকে কাফকো, বাংলাদেশ থেকে উত্তোলনকৃত সার পরিবহন ঠিকাদাররা লাইটার জাহাজ ও ট্রাকের মাধ্যমে বাফার গুদামসমূহে পরিবহন করে থাকেন। একইভাবে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট এর উৎপাদিত সার ট্রাকের মাধ্যমে বিভিন্ন বাফার গুদামে সরবরাহ করা হয়। অন্যান্য কারখানার উৎপাদিত সার নির্ধারিত জেলার ডিলারগণ সরাসরি ট্রাকযোগে কারখানা হতে সরবরাহ নিয়ে থাকেন।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান সার সরবরাহে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও সারাদেশে ডিসি-এসপিদের আলাদা আলাদা চিঠি দিয়েছে।
চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান চিঠিতে, পিক সিজনে কৃষকদের নিকট সময়মত সার সরবরাহের স্বার্থে সমুদ্র/নৌ বন্দর এবং বিভিন্ন ঘাট ও কারখানা হতে দেশের ৩০টি বাফার গুদামে নিরাপদে সার পরিবহণে প্রয়োজনীয় ট্রাক সংগ্রহে সহযোগিতা চাওয়া হয়।
সার পরিবহনকালীন নিরাপত্তা প্রদানের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান চেয়ারম্যান।
একইসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সার সরবরাহে সহযোগিতা প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সারাদেশের উপপরিচালকদেরকে নির্দেশনা প্রদান করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের চিঠিতে জানিয়েছে, বিএডিসি, বিসিআইসি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা সারের স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরী।