সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতবিরোধের সমাধান সম্ভব: সিইসি
আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি, জামায়াতসহ তাদের সমমনা বিরোধী দলগুলোর কঠোর বিরোধিতার মধ্যেই এ ঘোষণা দেওয়া হলো।
আজ বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রাজধানীর নির্বাচন ভবন থেকে সিইসির তফসিল ঘোষণা ভাষণ সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে দাবি করে সকল রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তফসিল ঘোষণার ভাষণে সিইসি বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন।
'আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সকল রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে।'
তিনি বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয় উল্লেখ করে সিইসি বলেন, 'পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।'
সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
একাদশ সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে।
তফসিল অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে, তা বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। এর তিন সপ্তাহ পর হবে ভোটগ্রহণ।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হবে। সেক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে এবং প্রচারের জন্য ১৯ দিন সময় রয়েছে। ৩০০ আসনেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
বর্তমান সরকার সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে।
তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয়েই জানিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিবে না তারা।
তফসিল ঘোষণার আগেই ইসলামী আন্দোলন নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিলের ঘোষণা দেয়। দলটি জানায়, তারা 'সরকারের একতরফা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাকে' সমর্থন করবে না।
এসব বিরোধিতার ঘটনা মাথায় রেখে, নাশকতা এড়ানোর যুক্তিতে- দেশের প্রধান প্রধান শহর ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবি সদস্যের মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার অংশ হিসেবে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের পাশে প্রায় ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সকাল থেকেই ইসি ভবনের আশপাশে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) দেশের ব্যবসায়ী নেতারা এফবিসিসিআইকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন কর্মসূচি না দিতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকেও আহ্বান জানান তারা।
এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য কারণে দেশের অর্থনীতি যখন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে– তখনই দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সহিংসতা ঘটছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। বিএনপি ও জামায়াত টানা অবরোধ কর্মসূচি দিচ্ছে।
রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে কেবল জাতীয় পর্যায় থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। ইসির তফসিল ঘোষণার আগেই এ চিঠি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ-সহ বেশকিছু শীর্ষ আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাও একই আহ্বান জানিয়েছে।
তবে গত ৩১ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে বলেছিলেন, "ট্রাম্প সাহেবের সাথে কী বাইডেন ডায়লগ করছে? যেদিন ট্রাম্প সাহেব আর বাইডেন ডায়লগ করবে, সেদিন আমিও ডায়ালগ করবো।"
বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে আসেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ডোনাল্ড লু'র চিঠিটি হস্তান্তর করেন। প্রায় আধাঘণ্টা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এরপর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, ওই চিঠির বিষয়ে তিনি দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সম্ভব হলে বুধবারই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।
এসময় কাদের বলেন, 'সংলাপ নিয়ে এখন আর চিন্তা নেই। সেটা আগে ছিল, সে সময় চলে গেছে।'
বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপ সম্ভব কিনা, সেই প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'সংলাপের কোনো সুযোগ নেই।'
অনেক বছর ধরেই দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল– আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অচলাবস্থা চললেও, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম রূপ নিয়েছে।
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ চলার মধ্যেই তা পুলিশি অ্যাকশনে পণ্ড হয়ে যাওয়ায় পরদিন হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
২৯ অক্টোবর ফখরুলকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এরপর আমীর খসরু ও মোয়াজ্জেম হোসেন-সহ বিএনপির অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির লাগাতার হরতাল, অবরোধ ও একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে পুরো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী-সহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলও বিএনপির হরতাল, অবরোধে সম্পৃক্ত হয়েছে।
এমনকী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনও পঞ্চম দফার অবরোধ ছিল বিরোধীদের।