জিয়ালা গ্রাম: পরিবেশবান্ধব এক মডেল দুগ্ধ পল্লী
'আগে সনাতনি পদ্ধতিতে গাভি পালন করতাম। গাভির প্রস্রাবের সঙ্গে গোবর লেপটে থাকাতো, দুর্গন্ধ ছড়াতো। নোংরা পরিবেশ থাকায় গরু রোগাক্রান্ত হতো। কিন্তু এখন আমরা ট্রেনিং পেয়ে পরিবেশ বান্ধব উপায়ে গরু পালন করছি। এতে পরিবেশ ভালো থাকছে আর আমাদের বাছুরের মৃত্যুহারও কমেছে। '
কথা গুলো বলছিলেন সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার জিয়ালা গ্রামের ঘোষপাড়ার চায়না ঘোষ। ঘোষপাড়া ঘুরে দেখা যায়, চায়না ঘোষের মতো শতাধিক খামারি এখন পরিবেশ বান্ধব উপায়ে গরু পালন করেন। সঠিকভাবে গোবর সংরক্ষণের ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০ টনের মতো গোবর বিক্রি করতে পারছেন তারা।
সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় জিয়ালা গ্রামটি দুগ্ধ-পল্লী হিসেবে প্রসিদ্ধ। তবে সনাতন পদ্ধতিতে গাভিপালন ও গোবর্জ্য অব্যবস্থাপনার ফলে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে।
এমন প্রেক্ষাপটে, ২০১৯ সালে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গ্রামটিতে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট (এসইপি) বাস্তবায়ন করে বেসরকারি সংস্থা 'উন্নয়ন প্রচেষ্টা'। প্রকল্পের মাধ্যমে জিয়ালা গ্রামের দুগ্ধ ক্লাস্টারকে একটি পরিবেশবান্ধব জিরোওয়েস্ট মডেল ক্লাস্টারে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ।
প্রকল্পটির অধীনে সারা দেশে ৬৪টি উপপ্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে তালা উপজেলায় এসইপি ডেইরি ফার্ম প্রকল্প একটি। এর আওতায় জিয়ালা গ্রমের ঘোষপাড়াতে গোমূত্র নিষ্কাশনের জন্য ৯৫০ মিটার দৈঘ্য একটি কমিউনিটি ভিত্তিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে ৮০ টি খামারির গোবর্জ্য যাচ্ছে। আর তৈরী করা হয়ছে একটি গোবর সংরক্ষণাগার। যেখানে খামারিরা প্রতিদিনের গোবর রাখে। এর ফলে একদিকে পরিস্কার থাকছে এলাকা অন্যদিকে গোবর বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন খামারিরা।
ঘোষপাড়ার ৯০ বছর বয়সী যাদব চন্দ্র ঘোষ বলেন, এই এলাকায় প্রায় ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে গাভি পালন হয়। নতুন এ প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে বাড়ি বাড়ি এসে কর্মীরা তাদের বোঝাচ্ছেন কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে খামার পরিচালনা করতে হবে।
চায়না ঘোষ ছিলেন একজন ছোট খামারি। এসইপি এর সহায়তায় তিনি দুটি থেকে এখন দশটি গরু দিয়ে খামার পরিচালনা করছেন। তাকে খামার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য খামারিদের মতো পশুর চিকিৎসাতেও তাকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন প্রতিদিন প্রায় ৬০-৭০ লিটার দুধ বিক্রি করেন ২,৫০০-৩,০০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্তা গোবর বিক্রি করেন ১৫ টাকায়।
চায়না ঘোষের খামারে দেখা যায়, ফ্লোর করা গোয়াল ঘরের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেন রাখা হয়েছে। জীবাণু মুক্ত রাখতে প্রবেশ পথে পটাশের পানি রাখা রয়েছে। সেখানে পা ধুয়ে খামারে প্রবেশ করা হয়। এছারা প্রতিটি গাভির জন্য খাবারের আলাদা পাত্র রয়েছে। পাত্রতে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে পানি খাবার জন্য গরু মুখ দিয়ে চাপ দিলে সাপ্লাইয়ের পানি পড়ছে, যেটা খেতে পারছে গরু।
উন্নয়ন প্রচেষ্টা জানায়, ঘোষপাড়াতে ১০০ থেকে ১২০ জন খামারি। যেখানে গাভির সংখ্যা ১,০০০ -১,২০০। প্রতিদিন প্রায় হয় ১৫-১৬ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয় । প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৪২ থেকে ৫৫ টাকায়। খামারিদের কাছ থেকে প্রাণ ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্ক ভিটাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন, 'আমরা এই প্রকল্পে ভ্যালু চেইনের সব অংশীজনকে যুক্ত করেছি। কিছু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গরু পালন করেন, কেউ উচ্চ মানের ঘাস জন্মায়, কেউ দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন করে এবং কেউ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবসা করে।
মোঃ গিয়াস উদ্দিন প্রতিবেদককে কমিউনিটি ভিত্তিক গোবর সংগ্রহ কেন্দ্র এবং সার্পেন্ট প্লাগ ফ্লো সিস্টেম দেখান, যার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য পরিশোধন করা হয় এবং নিকটবর্তী খালে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রকল্পে নিজস্ব পশু ডাক্তার আছে, তিনি পশু পালনের বিষয়ে খামারিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়। এর ফলে খামারিরা গরুর রোগ সম্পর্কে জানে এবং আগে থেকেই এ বিষয়ে সচেতন থাকে।
তিনি বলেন, খামারিদের আমরা একটি গোবর সংক্ষণাগার তৈরী করে দিয়েছি। ঘোষপাড়াতে প্রতিদিন ২০ টনের মতো গোবর জমা হয়। গোবর সংরক্ষণের কারণে এখানে ১২০ জন ভার্মি কম্পোস্ট উদ্যেক্তা তৈরী হয়েছে। ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরী করার বিষয় আমরা প্রশিক্ষণ দেই। সেই সঙ্গে উদ্যেক্তাদের ট্রেডলাইসেন্স থেকে শুরু করে পরিবেশ সার্টিফিকেট যেন পেতে পারে তাতে সহায়তা করি।
তৈরী হচ্ছে জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোক্তা
আট বছর ধরে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন মোড়ল আব্দুল মালেক। তার বাড়ির সামনের জায়গা ঘুরে দেখা যায় পুরো বাড়িটিই যেন একটি জৈব সারের কারখানা। বস্তা ভর্তি করে গোবর নিয়ে আসা হয়েছে ঘোষপাড়া থেকে। সেগুলো সিমেন্টের রিংয়ে ভরে রাখা হচ্ছে। গোবরের উপরে দিয়ে দেয়া হচ্ছে কেঁচো। এভাবে প্রায় দেড় মাস রেখে দেয়ার পর তৈরী হচ্ছে সার। বৃষ্টিতে পানি যেন না জমে সে জন্য আবার উপরে মাচা দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতি কেজি সার পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়।
আব্দুল মালেক বলেন, ২০১৪ সালে মাত্র মাত্র ৩টি রিং স্ল্যাব নিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেছিলাম। তবে বড় আকারে শুরু করি ২০১৮ সালে। দুই পর্যায়ে এসইপি থেকে ঋণ নিয়েছি ৮০ হাজার টাকা। এখন ৩০০ রিং স্ল্যাব চাড়ি রয়েছে এছাড়া পলিথিন বিছিয়ে বেড বানিয়েও কেঁচো সার তৈরী করছি।
আব্দুল মালেক বলেন, প্রথম যখন শুরু করি তখন আমাকে প্রতিবেশীরা অনেক গোবর মালেক বলে বিদ্রুপ করতো। এখন দেখা গেছে যারা আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো তারাও গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরি করছে।
তালা উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের আরেক উদ্যেক্তা আব্দুল আজিজ বিশ্বাস বলেন, আগে অন্যের বাসায় শ্রমিকের কাজ করতাম। ২০১৮ সাল থেকে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছি। এখন নিজের কাজ করছি। দেড় মাসে প্রায় ২০ টন সার উৎপাদন হয়। মাসে প্রায় ৬০ হজার টাকা আয় হয়।
জিয়ালা এবং আশেপাশের অঞ্চলের মানুষরা অনেক বেশি খামার নির্ভর। প্রায় প্রতিটি ঘরে একটি বা একাধিক গরু আছে। প্রকল্প শুরুর পর অনেকে এখন গরু পালনের পাশাপাশি গোবর দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেছেন।
তালা উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সঞ্জয় বিশ্বাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উন্নয়ন প্রচেষ্টা ঘোষপাড়াতে একটি পাইপলাইন করেছে। এতে ময়লা ও দুর্গন্ধের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এখন আর গোবর এখানে সেখানে রাখে না খামারিরা। এটি উপযোগী সিদ্ধান্ত, যা অন্যরাও অনুসরণ করতে পারেন। তবে ড্রেনের পাইপ আরও মোটা হলে ভালো হতো।
তিনি বলেন, তালা উপজেলায় প্রায় ৩,৫০০ এর মতো খামারি আছে যারা প্রায় ১ লাখ গাভি পালন করে। যেখানে প্রতিদিন ১ লাখ ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়।
জৈব সারে ভর্তুকি প্রয়োজন
আব্দুল মালেক বলেন, জৈব সার ব্যবহারে ফসল ভালো হয়। সরকার রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দেয়। এখন প্রয়োজন জৈব সারে ভর্তুকি দেওয়া। ভর্তুকি দেওয়া হলে জৈব সারের দাম কমে যাবে, কৃষকও এ সার আরও বেশি ব্যবহার করবে। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসবে। এতে জৈব সারের উদ্যেক্তাও বাড়বে।
জিয়ালা গ্রামের ঘোষপাড়াতে প্রবেশমুখের সংযোগ সড়কের অবস্থা ভালো নয়। দেখা গেছে, ভাঙা সড়কে কাদা জমে রয়েছে। এতে খামারিরা গরুর জন্য ঘাস বা খাবার পরিবহনে দুর্ভোগে পড়েন। শিবপুর ইউনিয়নের জৈব সার ক্লাস্টারেরও একই অবস্থা। সেখানের ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে সার পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে উদ্যেক্তাদের।
এ বিষয় তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, উপজেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে আমরা জানিয়েছি। স্থানীয় সরকার বিভাগ পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত সড়কগুলো তৈরী করে দিবে।