সমাজ যতো যান্ত্রিক হবে, হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ততো বাড়বে
আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সত্তর বছরের বৃদ্ধ চাঁন মিয়া প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বসে ছিলেন, ছেলে তাকে নিতে আসবে এই আশায়। এই বৃদ্ধ বলেছেন, তিনি নোয়াখালীর বাসিন্দা এবং তিন ছেলে, এক মেয়ের বাবা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। গত ৬ অক্টোবর তার বড় ছেলে হারুন ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় তাকে এই মাঝপথে অর্থাৎ এখানে হুইলচেয়ার সহ ফেলে রেখে গেছে।
অবশ্য চাঁন মিয়ার দূরসম্পর্কের এক ভাই জানিয়েছেন, ১৫ বছর আগে বাড়ি থেকে চলে যান চাঁন মিয়া। তিনি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফিরে না আসায় পরিবার ও স্থানীয়রা ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি মারা গেছেন। বৃদ্ধের চার সন্তানের সবাই ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। চাঁন মিয়ার বাম হাত-পা প্রায় অচল বলে উনি নড়াচড়াও করতে পারছেন না। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
কেউ যদি আমার কাছে জানতে চায়, জীবনের এইসময়ে এসে আমার সবচেয়ে ভয় কী, আমি বলি বার্ধক্য। এজন্য ভয় নয় যে, যৌবন বা তারুণ্য চলে যাবে। ভয় হচ্ছে একা হয়ে যাওয়ার, উপেক্ষিত হওয়ার, কাজ না করতে পারার এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার। আমাদের মতো দেশে বৃদ্ধ হলে কাজ করার ও আয় করার উপায় কমে যায়। আর তখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কেউ খোঁজ রাখতে চায় না বা রাখে না।
যারা সারাজীবন কাজ করেন, সন্তান ও ভাইবোনকে বড় করেন, তাদের পক্ষে বৃদ্ধ বয়সে অন্যের উপর নির্ভর করা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সহ্য করা খুব কঠিন হয়। আরও ভয় হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার, বাতব্যথা, ডিমনেশিয়াগ্রস্ত হওয়ার। টাকাপয়সা ও দায়িত্বশীল সন্তান না থাকলে বয়স্ক মানুষের জীবন মানবেতর হতে বাধ্য। যেহেতু আয়ুর উপর আমাদের কারো হাত নেই, তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না মানুষের। তবে এটাও ঠিক মানুষ সংসারের মায়াতেই বাধা পড়ে থাকতে চান, যেতে চান না।
কিন্তু সংসার কিভাবে প্রবীণ মানুষকে গ্রহণ করে? করোনাকালে দেখেছি সন্তানরা বৃদ্ধ বাবা মাকে রাস্তাঘাটে, জঙ্গলে, খালে-বিলে, কবরস্থানে, স্টেশনে কিংবা অন্য কোথাও ফেলে গেছেন। দুইবছরে ঘটনাগুলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। চলতি বছরের মে মাসের দিকে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ভারুয়া বিলে ৮৮ বছরের বৃদ্ধা বেগম খাতুনকে চোখমুখ ঢেকে ফেলে রেখে যান তার ছেলে। যাওয়ার সময় ছেলে বলে গিয়েছিলেন, একটু পরে এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরে আর সেই সন্তান মাকে ফিরিয়ে নিতে আসেননি। সেখানে তিন দিন পড়েছিলেন তিনি। এর চাইতে মর্মান্তিক ঘটনা আর কী হতে পারে একজন মায়ের জীবনে?
অন্য একটি ছেলে ঐ এলাকায় কাজ করতে গিয়ে দেখেন যে বৃদ্ধার নড়াচড়া নেই, মশা-মাছি ও বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ তাকে ঘিরে ধরেছে। দেখতে পেয়ে যখন তিনি ওই বৃদ্ধা মানুষটিকে কোলে করে তুলে আনেন, তখনও বৃদ্ধা মুখ ঢেকে ছিলেন এবং বলতে চাইছিলেন না যে, কিভাবে উনি এখানে এসেছেন। পরে অবশ্য পুলিশ আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ওই বৃদ্ধার পরিবারকে শনাক্ত করেছিল। বেগম খাতুন ও চান মিয়া একা নন, এরকম আরো অভিভাবককে তাদের সন্তানরাই ফেলে রেখে গেছে পথের ধারে, পুকুর পাড়ে।
অক্টোবরের ১ তারিখে পালিত হলো বিশ্ব প্রবীণ দিবস। 'সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ' (সিআইপিআরবি) জানিয়েছে, দেশে প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে তাদের মধ্যে একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব। হাসপাতালগুলোও প্রবীণবান্ধব হয়নি। পরিবর্তনশীল অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে প্রবীণদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ কমেই আসছে।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সিআইপিআরবি পরিচালিত 'অ্যাভেইলেবিলিটি অব সার্ভিসেস ইন এক্সিস্টিং হেলথ কেয়ার সিস্টেম ইন রিলেশন টু জেরিয়াট্রিক কেয়ার ইন ঢাকা সিটি' শীর্ষক একটি ছোট গবেষণায় উঠে এসেছে যে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত ১০টি হাসপাতাল যে প্রবীণবান্ধব, তা বলা যাবে না।
কারণ এই হাসপাতালগুলোতে প্রবীণদের ব্যবহার উপযোগী শৌচাগার, আলাদা বসার জায়গা, শয্যা নির্দিষ্ট থাকা, আলাদা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বা আইসিইউতে আলাদা শয্যা বরাদ্দ রাখা, প্রশিক্ষিত নার্স থাকার মতো বিষয়গুলো নেই। প্রবীণরা বলেছেন, চিকিৎসা নিতে গিয়ে তাদের হাসপাতালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে চিকিৎসক এবং নার্সদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রেই খারাপ।
যাদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে অথবা যারা বিদেশে থাকেন, তারা অনেকেই বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা-মায়ের জন্য কেয়ারগিভার রেখে দেন। প্রবীণদের জন্য কেয়ারগিভার বা প্রশিক্ষিত পরিচর্যাকারীর বিষয়টি খুবই জরুরি। অনেকসময়ই প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার পাওয়া না গেলেও, নিম্নমানের কেয়ারগিভারদের পেছনে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা কেয়ারগিভার সরবরাহ করে। কিন্তু উচ্চবিত্ত ছাড়া আর কারো পক্ষেই এই কেয়ারগিভার রাখা সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য আলাদা বিভাগ খোলার, সরকারিভাবে কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার, প্রবীণেরা যাতে সহজে ও স্বল্প খরচে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন, তার জন্য হেলথ কার্ড চালু করার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
এই ব্যস্ত সমাজে সবচেয়ে একাকী হয়ে আছেন প্রবীণ ও শিশুরা। বাবা-মাকে সংসারে রাখা যদিও সন্তানের একটি বড় দায়িত্ব, কিন্তু অন্যদিকে তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, সময় দেয়া, অসুখ-বিসুখে সেবা করা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা অনেক বড় দায়িত্ব ও খরচের ব্যাপার। তাই সন্তানদের অনেকে এই দায়িত্বপালন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না, এই বাবা-মাই তার জন্মদাতা এবং লালনপালন করে এনারাই সন্তানকে বড় করে তুলেছেন।
আমাদের সবারই ভাবা উচিৎ যে, আজকে যদি আমরা আমাদের বাবা-মায়ের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে যেদিন আমরা বুড়ো হবো বা অসুস্থ হবো, সেদিন কিন্তু আমার সন্তানও আমাদের পাশে দাঁড়াবে না। কারণ তারা দেখে শেখার সুযোগ পায়নি যে কিভাবে বয়স্ক বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে হয়।
একটা সময় ছিল যখন বয়োজেষ্ঠ্যরা ছোটদের গল্প শোনাতেন, ছোটদের পাশে বসে পিঠা-পুলি, আচার বানাতেন, বাচ্চাদের সাথে খেলতেন। শিশুরাও বড়দের পাশে থেকে মজা করে সময় কাটাতে ভালবাসতো। তখন দু'পক্ষই একাকীত্ব জিনিসটা বুঝতো না।
কিন্তু যখন থেকে পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার হয়ে গেল, তখন থেকেই পরিবারে বিচ্ছিন্নতা গেঁড়ে বসতে শুরু করলো। এখন মুঠোফোন, ভিডিও গেমস, টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুক সহ নানান প্রযুক্তি এসেছে। পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে গল্প ও হাসাহাসি করে আনন্দে দিন পার করার সময় কোথায়? এখন প্রবীণেরা একাকিত্বে ভুগছেন। এমনকি পাড়ায়-মহল্লায় কোন ব্যবস্থা নেই, যেখানে প্রবীণ মানুষরা একসাথে বসে গল্প করতে পারেন।
সন্তান যদি বাবা-মায়ের ঠিকমতো ভরণপোষণ না দেন, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার আইনও দেশে আছে। কিন্তু আইন দিয়ে কী হবে যদি আমাদের মধ্যে বিবেক, ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ না থাকে। অনেক পরিবারই আছে, যেখানে বাবা-মাকে ভাগ করে ফেলা হয়। হয়তো বাবার দায়িত্ব বড় ছেলে গ্রহণ করেন, মায়ের দায়িত্ব নেন ছোট মেয়ে। ভাইবোনদের সুবিধামতো বাবা-মাকে আলাদা করে ফেলা হয়।
অথচ আমরা জানি যে বাবা-মা একটি একক পরিচয় ও একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। দু'জনে মিলেই পরিবার, দুজনই সন্তানের দায়িত্ব একসাথে পালন করেন। কাজেই দু'জনকে আলাদা করে ফেলে দায়িত্বপালন করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সেজন্য আমাদের বুঝতে হবে যে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে ভাগ করা যাবে না, বরং তাদের জন্য যে ব্যয় হবে, তা সবাই মিলে ভাগ করে নেয়া উচিত।
আমাদের দেশের মানুষের আয়ু বাড়ছে। আয়ু বাড়া মানে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে যে এই প্রবীণ জনগোষ্ঠী কি পরিবার ও সমাজের উপর বোঝা হয়ে পড়বেন? সরকার প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়নে কি আদৌ কোন ব্যবস্থা নেবে? হাসপাতালে প্রবীণদের জন্য কত শতাংশ শয্যা বরাদ্দ থাকবে, প্রবীণদের হাসপাতাল খরচ, ওষুধের দাম, বাসে-ট্রেনে ও বিমানে কোন কনসেশন কি করা হবে?
প্রবীণদের বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা থাকার কথা থাকলেও, সেভাবে কিছুই নেই। আমাদের দেশে যেহেতু সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থা চালু নেই, তাই বয়স বেড়ে গেলেও মানুষ, যেমন করে হোক কাজ বা আয়ের সাথে যুক্ত থাকতে চান। মনে করেন আয় থাকলে সন্তানের কাছে মূল্য থাকবে, তাদের একটা আশ্রয় থাকবে। অনেকেই মনে করেন বার্ধক্য ভর করলেও, যদি কাজে জড়িত থাকা যায়, তাহলে শরীর চলতে থাকবে।
আমাদের দেশের প্রবীণদের অনেকেই জানেন সন্তানের পেছনে যেভাবে তারা শক্তি-সামর্থ্য ও টাকা-পয়সা খরচ করে বড় করে তুলেছেন, সেই সন্তানদের অনেকেই এখন আর বাবা-মায়ের কথা ভাবার বা তাদের প্রতি দায়িত্বপালনের কথা ভাবেন না বা ভাবার সময় পান না। প্রবীণদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নেই তেমন কোন সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি। প্রবীণদের কল্যাণে যাতায়াত ভাতা এবং অন্য কোন অনুদান ভাতা নেই। ফলে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মানে হলো, এককভাবে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি।
সময়টা এখন এমন হয়েছে যে, প্রবীণদের অনেকেই একাকী বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা করার পেছনে যেহেতু পরিবারকে ভাল পরিমাণ অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়, তাই বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটাই সহজ মনে হয় অনেক সন্তানের কাছে। অথচ সন্তানরা ভাবতে চান না যে তাদের এই বড় হওয়ার পেছনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাদের অবদানকে সম্মান জানানোর কোন প্রয়োজনীয়তা এখন আর কেউ বোধ করে না।
অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে মা-বাবা আমাদের অনেকের কাছেই বোঝা। একক পরিবারিক কাঠামোতে আমরা বাবা-মাকে আশ্রয়, ভালবাসা, সেবা যত্ন দিয়ে রাখতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি? বাবা মা যদি সম্পত্তির মালিক হন তখন তাদের প্রতি যেরকম আচরণ করি, সম্পত্তিহীন হলেও কি তেমনটা আচরণ করি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের আবেগঘনিষ্ঠ ছবি ও স্ট্যাটাস দেখে বোঝার উপায় নেই প্রকৃত অবস্থাটা আসলে কেমন। জীবন-জীবিকা, পরিবারের চাপ, আর্থিক সামর্থ্য, নিজেদের স্বার্থপরতা এবং দায়িত্বজ্ঞান বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সবসময় তা প্রকাশ্যেও আসে না, কারণ পারতপক্ষে বাবা-মা সন্তানের স্বার্থপরতার কথা শেয়ার করতে চান না।
মা-বাবার প্রতি নির্মম ব্যবহারের খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই আসছে। জমিজমা বা সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য মাকে খুন করা, প্রয়োজন মতো টাকা দিতে না পারায় বাবাকে খুন বা হত্যার হুমকি এবং বাসা থেকে বের করে দেয়ার খবরও চোখে পড়ছে। তবে অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর প্রায় ৯৯ শতাংশই প্রবীণ নারীদের পরিত্যাগ করার এবং দরিদ্র পরিবারের কাহিনি বেশি প্রকাশিত হয়। (সূত্র: প্রথম আলো)।
অধিকহারে নারীদের পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ কী? নারীর গড় আয়ু বেশি? সন্তানেরা মাকে পালন করতে গিয়ে কি ধৈর্য হারাচ্ছেন? নারীর হাতে সম্পত্তি কম বা সম্পত্তি নেই বলে? যে মায়েদের হাতে গচ্ছিত অর্থ থাকেনা, তারা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে ছেলে বা মেয়ের সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। এই চিত্র খুব অপ্রিয় হলেও সত্যি। গ্রামে ও শহরে, ধনী, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের মধ্যে একইভাবে সত্য।
বয়স্ক পুরুষ ও নারীর সাথে কথা বললে বোঝা যায়, কতটা অনাদরে, অবহেলায় মানুষগুলো বেঁচে আছেন। পত্রপত্রিকায় সব ঘটনা ছাপা হয় না। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম থেকে গত পাঁচ বছরে মাকে রাস্তাঘাটে ফেলে যাওয়ার ২২৩টি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবে এমন ঘটনা হয়তো আরও অনেক বেশি ঘটেছে বা ঘটছে (প্রথম আলো)।
বিভিন্ন সময়ে আমরা খবরের কাগজে ও দেয়ালে বিজ্ঞাপন দেখি যে বয়স্ক মানুষ হারিয়ে গেছেন, তার সন্ধান জানতে চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে পরিবার। এদের কেউ ফিরে আসেন, কেউবা হারিয়ে যান, কেউবা চাঁন মিয়ার মতো পথের ধারে বসে থাকেন সন্তানের আসার অপেক্ষায়।
এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অনেকেই হয়তো বার্ধক্যজনিত ডিমেনশিয়া (স্মৃতিক্ষয়) রোগে আক্রান্ত। অনেকে জানিই না, এটা কী অসুখ? ডিমেনশিয়ায় ভুগতে থাকা বয়স্ক মানুষ তাদের ঠিকানা, পরিচয়, অবস্থান ও সময় সম্পর্কে ঠিকমতো কিছু বলতে পারেন না বা ভুলে যান। এ কারণে তারা একবার বাড়ি থেকে বের হলে কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে ভুলে যান এবং একসময় হারিয়ে যান।
মানুষের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে স্মৃতিক্ষয় রোগ। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। সমাজ যতো জটিল ও যান্ত্রিক হবে, মানুষের আয়ু যতো বাড়বে, আবেগ-অনুভূতি ও ভালবাসা কমবে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতা বাড়বে, ডিমেনশিয়ার মতো অসুস্থতা ততোই বাড়বে। সমাজের মানুষ ততো বেশি হারিয়ে যাবে।
- লেখক- যোগাযোগকর্মী ও কলামিস্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।