চট্টগ্রামে গ্যাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে লাগবে আরও ১২ ঘণ্টা, দুর্ভোগে নগরবাসী
গৃহিণী শাহেনা বেগম। স্কুলগামী সন্তান নাজিয়াকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েছিলেন একটি বেকারির সামনে। কিন্তু সকাল নয়টার আগেই দোকানটির সকল বেকারি পণ্য বিক্রি হয়ে যায়, শেষবেলায় থেকে যাওয়া দুটো বনরুটি নিয়েই বাসায় ফিরতে হয় শাহেনাকে। তিনি জানেন না সকালে তার শিশুকে রুটি দিলেও দুপুরে ভাত দিতে পারবেন কিনা।
একটু দূরেই ছোট টেবিল পেতে তাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কিছু খিচুরির প্যাকেট আর পাটিসাপটা। গ্যাসের অভাবে মানুষের খাবারের চাহিদাকে মাথায় রেখে বসেছে তৈরী খাবারের এই পসরা। এসব দৃশ্য চট্টগ্রামের চাঁন্দগাঁও আবাসিক এলাকার।
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীতে সাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ রাখায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গত শুক্রবার রাত থেকে চট্টগ্রামে চলছে গ্যাস সংকট। যার কারণে বাসায় জ্বলছে না চুলা, খাবারের খোঁজে হোটেলে ছুটছে মানুষ। কিন্তু লাইনের গ্যাসনির্ভর হোটেলগুলোতে রান্না না হওয়ায় সিলিন্ডার দিয়ে চলছে হোটেলে রান্নাও। সংকটের সুযোগ নিয়ে একলাফে ৩৫০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম।
এদিকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের দাবি, তারা গতকাল রাত থেকে চট্টগ্রামে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ও শিল্পকারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা এখনো গ্যাস পাচ্ছেন না।
গৃহিণী শাহেনা বেগম বলেন, 'সকালে বাচ্চাকে কিছু না খাইয়েই স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় দোকানগুলোতে গিয়ে বেকারি বা হাতে বানানো কিছুই পাইনি। দুটো রুটি নিয়েছি, মেয়েটাকে খাওয়াবো বলেন। গ্যাস না আসলে দুপুরে কী হবে জানি না।'
অক্সিজেন এলাকার গৃহিণী নাজমা বেগম বলেন, শুক্রবার থেকে গ্যাস একেবারে বন্ধ ছিলো। গতকাল রাত থেকে অল্প অল্প আসছে, যা দিয়ে রান্না করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে কেরোসিনের স্টোভ কিনে ব্যবহার করছি।'
অন্যদিকে, সিএনজি স্টেশনগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও মিলছে না পর্যাপ্ত গ্যাস। ফলে নগরীর গ্যাসচালিত গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি একপ্রকার বন্ধই রয়েছে। গণপরিবহন সংকটে অফিসগামী মানুষ ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায় হাজারো যাত্রীদের জটলা। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও বাস বা টেম্পু আসছেনা। এ অবস্থায় অনেকে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। ডিজেলচালিত টেম্পুগুলো চলাচল করলেও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুন ভাড়া। বাস না পেয়ে যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে উঠছেন টেম্পুগুলোতে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী জুনায়েদ হোসেন বলেন, 'সকাল থেকে অপেক্ষা করছি, একটা গাড়িও পাচ্ছি না। সিএনজি চালকরা ১০০ টাকার ভাড়া ৩০০ টাকা চাইছে। এই সুযোগে রিকশাওয়ালাও ডাবল ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। এখন আমি অফিসে যেতে পারছি না।'
এদিকে গ্যাসের সরবরাহ সংকটে বেড়েছে লোডশেডিং। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে দৈনিক ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াট। রাউজান ও শিকলবাহা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দুটি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় এসব কেন্দ্র থেকে ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে আছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। কেজিডিসিএলের মোট গ্রাহক-সংযোগ ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে। এসব খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে পাওয়া যায় ২৭০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বেলা সাড়ে ১১টায় টিবিএসকে বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। গতকাল রাত থেকে আবাসিক ও শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছি। এই মুহুর্তে চট্টগ্রামে চাহিদার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে।'
তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত টিবিএসকে বলেন, 'এই মাত্র বাসা থেকে বেরোলাম, সেখানে গ্যাস নেই। কারখানাতেও গ্যাস নেই, তাহলে কেজিসিএল কাকে গ্যাস দিচ্ছে? গ্যাসের অভাবে আমাদের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।'
নগরবাসীর এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'চট্টগ্রাম ২০১৮ সাল থেকে পুরোপুরিভাবে এলএনজির উপর নির্ভরশীল। জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে আমরা কোনো গ্যাস পাই না। চট্টগ্রামকে দেওয়ার পরই বাকি গ্যাস কুমিল্লা ও ঢাকায় পাঠানো হয়। তাই এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামই সবচেয়ে বেশি ভুগছে। আমরা গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছি, কিন্তু সেটি এখনো জিরো প্রেশারে আছে, পুরোপুরিভাবে চালু হতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগবে।'