ভূগর্ভস্থ মেট্রোর খরচ বাড়ছে ২,৩১৬ কোটি টাকা
ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন ১ প্রকল্পটি প্রায় ২,৩১৬ কোটি টাকা বা ৪.৪১% অতিরিক্ত ব্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল লাইন ও নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত এলিভেটেড লাইন নির্মাণে অতিরিক্ত ৩৯.১৭ একর জমির প্রয়োজন হবে। এর ফলে প্রাথমিক অনুমান থেকে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় ৯৮% বাড়বে।
সম্প্রতি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২ মার্চ প্রকাশিত সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, এতে বর্ধিত ব্যয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সভায় প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের পর প্রকল্পের অন্যান্য খাতের জন্য বিদ্যমান তহবিল থেকে অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থ নেওয়া হবে। এই অতিরিক্ত খরচ প্রকল্পের পরবর্তী পুনর্বিবেচনাগুলোতে সামঞ্জস্য করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, স্টেশন, সাবস্টেশন, ফায়ার এক্সিট, ডিপোর জন্য এক লেনের প্রবেশ পথ, ট্রানজিট-ভিত্তিক উন্নয়ন হাব, এবং স্টেশন প্লাজাগুলোতে প্রস্থান এবং প্রবেশের পয়েন্ট তৈরির জন্য আরও জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন।
তিনি যোগ করেন, পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি সংশোধন না করেও মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫% পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয়ের বিধান রয়েছে।
বৈঠকের নথি থেকে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ৯৭.১৫ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২,৩৫৫ কোটি টাকার বিধান রয়েছে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মেট্রো লাইনের কাজ সম্পন্ন করতে আরও ৩৯.১৭ একর জমি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মোট ১৩৬.৩২ একর জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজে প্রয়োজন ৪,৬৭,০৬২ কোটি টাকা।
সভায় প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি মেট্রো লাইনের জন্য অন্তত একটি ট্রানজিট-ভিত্তিক উন্নয়ন হাব এবং চারটি স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করা হবে। সেজন্য রাজউকের মালিকানাধীন অতিরিক্ত ১৮ একর এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন অতিরিক্ত ৯ একর জমি অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করতে হবে।
জমি হস্তান্তর ত্বরান্বিত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জোর দেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিচালক মো. মাহমুদ হাসান।
সভায় এম এ এন সিদ্দিক নতুন বাজার মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন রাজউকের জমি বরাদ্দের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে বলেন, আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় জমি অধিগ্রহণে বিলম্বের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়।
২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ৫২,৫৬১.৪৩ কোটি টাকা।
এরমধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) দিবে ৩৯,৪৫০.৩২ কোটি টাকা, যা প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৭৫.০৬%।
৩১.২৪ কিলোমিটারের এ প্রকল্পের ১৯.৮৭ কিলোমিটার (বিমানবন্দর-কমলাপুর) হবে একটি ভূগর্ভস্থ লাইন এবং অবশিষ্ট ১১.৩৭ কিলোমিটার (নতুন বাজার-পিতলগঞ্জ) হবে এলিভেটেড লাইন।
এলিভেটেড অংশের জন্য বারোটি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং নয়টি থাকবে মাটির উপরে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পূর্বাচল সংলগ্ন পিতলগঞ্জে ডিপো এলাকায় সয়েল ইম্প্রুভমেন্ট ও ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।
এমআরটি লাইন ৫ এর নির্মাণকাজে বিলম্ব
আগামী বছরের জুনে এমআরটি লাইন ৫এর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের নকশা সময়মতো শেষ না হওয়ায় তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গাবতলী থেকে আসাদ গেট, পান্থপথ, হাতিরঝিল ও আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭.৪ কিলোমিটারের মেট্রোরেলটি নির্মাণ করা হবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, চলতি বছরের জুনের মধ্যে মূল এমআরটি লাইন ৫ প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করতে ২০২০ সালে ৪০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সহায়ক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-র অর্থায়নে এই সহায়ক প্রকল্পে বেশ কিছু জরিপ ও নকশা জড়িত।
লাইন ৫ এর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন এ বছরের মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ৮% কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। এ কারণে সহায়ক প্রকল্পটির সময়সীমা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল ওহাব জানান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে পাঠানো এ প্রস্তাবের বিষয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে সহায়ক প্রকল্প শুরু করতে বেশি সময় লেগেছে। তবে এমআরটি লাইন ৫ এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনে খুব বেশি দেরি হবে না কারণ সহায়ক প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও মূল প্রকল্পের টেন্ডার কাজ একইসাথে এগিয়ে চলেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রস্তাবিত লাইন ৫-এ ট্রেন চালানো সম্ভব হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সময়সীমা এক বছর বাড়ানোর পাশাপাশি জরিপ প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নিয়ে কমিশন কোনো আপত্তি জানায়নি।
তবে জরিপ প্রকল্পে অতিরিক্ত সময় নেওয়ায় মূল প্রকল্প বিলম্বিত হতে পারে বলে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
৪.৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এম আরটি লাইন ৫ (দক্ষিণ রুট)-এর মূল প্রকল্পের প্রাথমিক ডিপিপি'র খসড়া এরমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে সরকারি তহবিল আনুমানিক ২.১ বিলিয়ন ডলার।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্পটিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। সরকার এ এজেন্সির কাছ থেকে আরও ৩০০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের স্টাডিতে অতিরিক্ত সময় নষ্ট করায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল হক।
তিনি বলেন, রাজধানীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তিকে যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এই এলাকার যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে মেট্রো রেল একটি বড় ভূমিকা পালন করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।