চট্টগ্রামে মেট্রোরেল চান না বিশেষজ্ঞরা, স্বল্প ব্যয়ে বিআরটি বা বাস লেন করার পরামর্শ

চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের চেয়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট—বিআরটি বা গণপরিবহন বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন নির্মাণের প্রস্তাবনা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মেট্রোরেলের মতো ব্যয়বহুল গণপরিবহন অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই এমন এক সময় করা হয়েছে, যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব মহামন্দার দিকে যাচ্ছে আর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই মন্দার সময় চট্টগ্রাম নগরে মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সত্যি অত্যাবশ্যকীয় কি না, সে প্রশ্ন রাখেন বিশেষজ্ঞরা।
রবিবার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরীর প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। 'বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ ভৌত অবকাঠামো কোন পথে!' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলেন লিখিত বক্তৃতা করেন ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। এতে মেট্রোরেল, বিআরটি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, মহাপরিকল্পনা নিয়ে তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, '২০০৩ সালে জিটিজেড (জিটিজেড জার্মান এজেন্সি ফর টেকনিক্যাল ফর টেকনিক্যাল কো-অপারেশন) সমগ্র বিশ্বে যত মেট্রোরেল ছিল, তার ওপর একটা তুলনামূলক সমীক্ষা করে। সমীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি সিদ্ধান্ত দেয় যে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) মেট্রোরেলের মতো উন্নতমানের সেবা দিতে পারে মেট্রোরেল খরচের মাত্র ভগ্নাংশ খরচ দিয়ে। কম বিনিয়োগে, কম যানবাহনে, কম জায়গায়, কম খরচে, স্বল্প সময়ে, আরামে ও নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতে পারবে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণার ফসল হলো বিআরটি সিস্টেম। এর নির্মাণ, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেট্রোরেলের চাইতে অনেক কম। ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সপোর্টেশন এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পলিসি কান্ট্রি ডাইরেক্টর ফর ইন্দোনেশিয়ার সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে ৪২৬ কিলোমিটার বিআরটি করিডর নির্মাণ করা যায়। সমপরিমাণ টাকা দিয়ে হালকা রেল (এলআরটি) করা যায় ৪০ কিমি, আর এলিভেটেড মেট্রোরেল করা যায় ১৪ কিমি, মাটির নিচে মেট্রোরেল করা যায় ৭ কিমি। বর্তমানে বিশ্বের ৪১টি দেশের ১৮৬টি নগরীতে 'বিআরটি' সিস্টেম ৪ হাজার ৭৫৭ কিমি করিডোর প্রতিদিন ৩২ মিলিয়ন যাত্রীকে উন্নতমানের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।'
মেট্রোরেল নির্মাণে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন উল্লেখ করে সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'সাম্ভাব্যতা যাচাই করতে ২-৩ বছর লাগবে। সবকিছু মিলে ১০ বছর লাগবে। এই ১০ বছর কি চট্টগ্রামবাসী অসহনীয় যানজটে দিনাতিপাত করবে? চট্টগ্রামের ১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনায়, ২০০৮ সালে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান এবং ২০১৮ সালের স্ট্র্যাটেজিক মাস্টারপ্ল্যানে সুপারিশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানবাহন ব্যবস্থাপনা (টিডিএম), গণপরিবহন বাসের জন্য আলাদা (ডেডিকেটেড) লেন করা, ফুটপাত ব্যবস্থাপনা, জাংশান ডিজাইন সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, বিদ্যমান সড়কের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিআরটিও যদি সময়সাপেক্ষ হয়, তবে আগামীকাল থেকেই গণপরিবহন বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন করা সম্ভব।'
মেট্রোরেলের প্রসঙ্গে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বলা হয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে রাজধানী ঢাকার মত জনসংখ্যা নেই। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন যাত্রী ট্রিপ হয় ২১ মিলিয়ন। আর চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন যাত্রী ট্রিপ হয় ৬.৭ মিলিয়ন যা ২০৩০ সালে হতে পারে ১০.৪ মিলিয়ন ট্রিপ। বন্দর নগরীতে যানবাহনের মধ্যে বাস-মিনিবাস ০৮ শতাংশ, প্রাইভেট কার ১০ শতাংশ, বেবি ট্যাক্সি ৩৯ শতাংশ এবং রিক্সা ৪৩ শতাংশ। চট্টগ্রামের মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকায় বিআরটির পরিকল্পনায় ভুল ছিল। এজন্য অনেক জটিলতা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিআরটি জন্য করিডর ঠিক করা আছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সমালোচনা করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো এবং সক্ষমতা চট্টগ্রাম উন্নয়ন সিডিএর ছিল না এবং এখনও নেই।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান, ফোরামের উপদেষ্টা অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী, সহসভাপতি প্রকৌশলী এবিএমএ বাসেত, স্থপতি আহমেদন জিন্নুর, স্থপতি বিধান বড়ুয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসলিমা মুনা, সদস্য অধ্যাপক ড. নাজিম উদ্দিন ও তানভীর পিয়াল।