বৈদেশিক ঋণ প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণই থাকবে
আগামী বছরের বিদেশি ঋণের প্রবাহ কোন দিকে যাবে- সেটা খুবই গুরত্বপূর্ণ। এই আলোচনার আগে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আগামী বছরে চলতি তহবিলের ঘাটতি খুব একটা কমবে না। কিছুটা কমে আসলেও এই ঘাটতির আকার অনেক বড়ই থাকবে।
কারণ বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমে আসলেও, এখনও অস্থিতিশীলতা রয়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আর অন্যান্য পরিস্থিতি খুব ভালো হলে ঘাটতির পরিমাণ হয়ত ১৮ বিলিয়ন ডলার না হয়ে, ১৪ বিলিয়ন হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিরাপদ পর্যায়ে ধরে রাখতে হলে– এই পরিমাণ বৈদেশিক অর্থায়ন লাগবে।
সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট আর ইক্যুইটি ফাইন্যান্সিং- এর মাধ্যমে এই বিশাল পরিমাণের অর্থায়ন আসবে না। কাজেই কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স সামাল দিতে আমাদের বিদেশি ঋণের দিকেই চেয়ে থাকতে হবে। আর এই ঋণ সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই আসতে পারে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ঋণের অধিকাংশই আসছে সরকারি খাতে।
সাম্প্রতিক ব্যালেন্স অভ পেমেন্টের তথ্যউপাত্ত বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি হিসাবের ঘাটতি অনেক বড় হয়েছে। সেই সাথে (বৈদেশিক) অর্থায়ন হিসাবেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
আগে চলতি হিসাবের ঘাটতির তুলনায় মোট অর্থায়ন কিছুটা কম থাকত। তবে অর্থায়ন হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ঘাটতি কিছুটা কমে আসত।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থায়ন হিসাবেও 'নেতিবাচক প্রবাহ' দেখা যাচ্ছে। এই হিসাবে এবার বিদেশি ঋণে ইনফ্লোর চাইতে আউট ফ্লো বেশি হয়েছে। এটা অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বাড়াচ্ছে।
একারণে শুধু চলতি হিসাবের ঘাটতি পরিশোধেই ফরেক্স রিজার্ভ লাগছে না, বৈদেশিক অর্থায়ন হিসাবের ঘাটতি তথা নেট ডেবট ফ্লো'র ঘাটতি পরিশোধেও ডলার লাগছে।
এজন্যে আমাদের চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও নেট অর্থায়ন হিসাবের ঘাটতি মেটাতে আরও ১২-১৪ বিলিয়ন ডলার লাগবে। এখন এটা আসার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা বড় প্রশ্ন।
বিদেশি ঋণের বড় অংশ আসে প্রকল্প বাস্তবায়নে। এ সংক্রান্ত প্রক্ষেপণ জাতীয় বাজেটে রয়েছে। এ খাতে বরাবর যা বাস্তবায়ন হয়, এবার এর বেশি হবে না বলে– প্রথম কয়েক মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে বলা যাচ্ছে।
এর বাইরে সরকার এডিবি ও এআইআইবি থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার করে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক থেকেও ২৫০ মিলিয়ন পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে যোগ হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রথম কিস্তির ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। সবমিলিয়ে বাজেট সহায়তায় দেড় বিলিয়ন ডলারের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে, যার পরিমাণ হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে।
অনিশ্চয়তার জায়গাটা হলো বেসরকারি খাতের ১৮-১৯ বিলিয়ন ডলার স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ রয়েছে, যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। দেখতে হবে, এই ঋণগুলোর কতটা রোলওভার সম্ভব। কিছু ঋণের রোলওভার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
সেটা নাহলে- বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধে অর্থায়ন হিসাবে বড় ধরনের চাপ আসবে। সেক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে গেলে– রিজার্ভ ও মুদ্রার বিনিময় হারে চাপ আরও তীব্রতর হবে।
আর্থিক হিসাবে ১৪ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি সামনে রেখে, আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫-৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আর বাজেট সহায়তা মিলে মোট সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭০০-৭৫০ কোটি ডলার।
বাকি অর্ধেক অর্থ কোথা থেকে আসবে?- এটা একটা প্রশ্ন। আবার বেসরকারি খাতের ঋণের রোলওভার না হলে সেগুলোর রিপেমেন্ট কোথা থেকে আসবে? কাজেই সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ কোথায় দাঁড়াবে– তা এখন বলা কঠিন।
এ অবস্থায় রিজার্ভের চাপ কমাতে– বৈদেশিক মুদ্রার দেশমুখী প্রবাহ বা ইনফ্লো বৃদ্ধির সব ধরনের উদ্যোগই নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
বিনিময় হারে তারতম্যের কারণে প্রতি মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে– বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসছে। এই তারতম্য না রেখে, বছরে এই পরিমাণ ডলার বৈধ চ্যানেলে 'ডাইভার্ট' করতে পারলেও ঘাটতির বড় অংশ মিটে যায়।
বিনিময় হারে তারতম্যের কারণে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে অনেকেই বাড়তি সময় নিচ্ছেন। আবার রপ্তানি আয়ও আসছে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে। কাজেই বিনিময় হারকে একেবারেই উদার করে দেয়া সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ। একইসঙ্গে, সুদ হারের সীমা নির্ধারণও বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
আর্থিক হিসাবের ঘাটতি মোকাবেলার জন্য মুদ্রানীতির আওতায় উদ্যোগ নিতে হবে। 'ফিসক্যাল পলিসি' তথা সরকারের বাজেটের মাধ্যমে এই চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
তবে বিনিময় হার ছেড়ে দিলে তাৎক্ষনিক ফলাফল পাওয়া যাবে এমনটা নয়। এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখতে কৃচ্ছ্রতা সাধন নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে সহায়ক এমন প্রচেষ্টাগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিদেশি ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সরকারের অর্থের কিছুটা সাশ্রয় হতে পারে। আবার ডলারের সরবরাহও বাড়তে পারে। আমাদের পাইপলাইনে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে, সেখান থেকে তত অর্থই ছাড় হবে। একইসঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমও এগিয়ে যাবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশি সহায়তার অর্থ ব্যবহারে কখনই কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না।
ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ
তার সঙ্গে আলাপ করেন টিবিএসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাহিদুল ইসলাম