উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমছে তরল গুড়ের উৎপাদন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষিনির্ভর বিজয়নগর উপজেলায় কয়েক যুগ ধরে তৈরি হচ্ছে তরল গুড়। আখের রস থেকে তৈরি এই গুড় স্থানীয়ভাবে 'লালী' নামে পরিচিত। শীতকালে বিভিন্ন পিঠা-পুলির সঙ্গে মুখরোচক লালী স্বাদে আনে ভিন্নতা। অনেকে আবার মুড়ির সঙ্গে মেখেও স্বাদ নেন লালীর।
এবছর ১ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের লালী বিক্রির আশা কৃষি বিভাগের। তবে গেল বছর লালী বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি টাকারও বেশি। মূলত উৎপাদনে খরচ বাড়ায় লালীর উৎপাদন কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, কসবা ও আখাউড়া উপজেলার কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে আখ চাষ করা হয়। এসব আখের রস থেকে লালী উৎপাদন করেন চাষীরা। চলতি বছর জেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। তবে এবার বাণিজ্যিকভাবে শুধুমাত্র বিজয়নগরেই লালীর উৎপাদন হচ্ছে। এ উপজেলার ২৫ হেক্টর জমিতে চাষ করা আখ থেকে অন্তত ১০০ টন লালী তৈরি হবে আশা করছে কৃষি বিভাগ। যার বাজারমূল্য ১ কোটি টাকারও বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর, দুলালপুর ও বক্তারমোড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় বাণিজ্যিকভাবে লালী উৎপাদন করে করে আসছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে লালী তৈরির কাজ শুরু করে পরিবারগুলো। মূলত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে লালী তৈরি ও কেনাবেচা। প্রতি কেজি লালী বা তরল গুড় খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।
লালী নেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন আসছেন বিজয়নগরে। লালীর উৎপাদন কাজ দেখতে রীতিমতো ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। অনেকে লালী নেওয়ার পাশাপাশি আখের রসও খেয়ে যাচ্ছেন।
যেভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু লালী বা তরল গুড়
প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে লালী তৈরির কর্মযজ্ঞ। প্রথমেই চলে আখ মাড়াই। মহিষের চোখ ঢেকে ঘানি টানানোর মাধ্যমে আখ মাড়াই করে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর রস জমিয়ে ছাঁকনি নিয়ে ছেঁকে রাখা হয় বড় কড়াইয়ে। পরবর্তীতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয় আখের রস। এরপর সেই রস লাল রং ধারণ করলে নামানো হয় কড়াই থেকে। এভাবেই তৈরি হয় মুখরোচক লালী বা তরল গুড়।
তবে প্রতিবছরই লালী তৈরিতে খরচ বাড়ছে কৃষকদের। এবারের মৌসুমে আখ কাটা এবং মাড়াইয়ের কাজে একজন শ্রমিককে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে। যা গেল বছর ছিল ৪০০ টাকা। এছাড়া ঘানি টানানোর জন্য আগে যে মহিষ ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় কেনা গেছে, তা এবার ৩০-৪০ হাজার টাকা বেশি দামে কিনতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন লালী উৎপাদনে জড়িতরা। ফলে খরচের তুলনায় লালী ব্যবসা লাভজনক না হওয়ায় উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন তারা।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ছতরপুর গ্রামের বাসিন্দা বিলকিছ চৌধুরী জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে তিনি দুলালপুর থেকে লালী কিনে নিয়ে যান। সুস্বাদু এই তরল গুড় তার বাড়ির সবাই অনেক পছন্দ করেন। বিভিন্ন পিঠার সাথে লালী খেতে অনেক ভালো লাগে বলে জানান তিনি।
দুলালপুর গ্রামের বাসিন্দা ও লালী উৎপাদনকারী রুক্কু মিয়া জানান, কয়েক বছর আগেও তাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আখ চাষ করত। কিন্তু দিন দিন আখ চাষীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আখ কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। ঘানি টানানোর জন্য লাখ টাকা বা তার বেশি দিয়ে মহিষ কিনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে লালী তৈরিতে যে খরচ পড়ছে, সে অনুযায়ী দাম পাওয়া যায় না।
আরেক চাষী সহিদ আকবড় জানান, বংশপরম্পরায় তিনি লালী তৈরি করছেন। তবে ভালো লাভ না হওয়ায় বিগত সময়ের চেয়ে এবার কম জমিতে আখ চাষ করেছেন। তাছাড়া সরকারি প্রণোদনাও পান না আখ চাষে। এজন্য জমিতে এখন লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলের চাষ করেন। এসব ফল চাষ লাভজনক বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুশান্ত সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বছর ১০০ টনের মতো তরল গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। কীভাবে আখের ফলন বৃদ্ধি করে গুড়ের উৎপাদন বাড়ানো যায়- সে সম্পর্কে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আখের জমিগুলোতে কৃষকরা লিচু, কাঁঠাল ও পেয়ারার মতো চাহিদাসম্পন্ন ফলের চাষ করছেন।'