বন্ধের পথে নওগাঁ গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটি
গত দুই বছর থেকে বন্ধ আছে নওগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুক্তির মোড়ের পাশে অবস্থিত 'গাঁজা সমবায় হিমাগার', ৩৫ বছর আগে গাঁজা উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পর গাঁজা সোসাইটির এ হিমাগারটি এক মেয়াদি ইজারা দেওয়া হতো, ২০২০ সাল থেকে ইজারা দিতে না পারায় হিমাগারটি এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে।
গাঁজা সোসাইটির (নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতি লিঃ অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে হিমাগারটি তৈরি করা হয়েছিল। তিনটি ঘরে ধারণক্ষমতা প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন। এটি ২০০৪ সাল পর্যন্ত মার্কেটিং সোসাইটির আওতায় ছিল। এরপর ২০০৫ সালে গাঁজা সোসাইটির আওতাভুক্ত হয়। এখানে আলু রাখা হতো।
এটি ছিল নওগাঁ জেলার একমাত্র হিমাগার। ২০০৬ সাল থেকে এক মেয়াদি ইজারা দেওয়া হতো। প্রতি বছর ৩ লাখ ৩৬ টাকার হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। যেখান থেকে বছরে আয় হতো প্রায় ১০ লাখ টাকা। সর্বশেষ ইজারা দেওয়া হয় বছরে ২ লাখ ১২ হাজার টাকায়।
২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শহরের মো. শেখ আল মামুন নামে এক ঠিকাদারের কাছে ইজারা ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে হিমাগারটি ইজারা দেওয়ার জন্য গাঁজা সোসাইটি থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু কোন ইজারাদার ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এরমধ্যে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ফলে দুই বছর থেকে ইজারা না হওয়ায় হিমাগারটি বন্ধ হয়ে যায়।
এক সময় জেলার মধ্যে একমাত্র হিমাগার ছিল গাঁজা সোসাইটির। সে সময় আলুর বীজ রাখার জন্য প্রচুর চাহিদাও ছিল। আগ্রহ সহকারে ব্যবসায়ী ও কৃষকরা আলুর বীজ সংরক্ষণ করতো। তবে জেলায় ব্যক্তিগত হিমাগার তৈরী হওয়ার পর থেকে গুরুত্ব কমতে থাকে।
জেলায় এখন চারটি কোল্ড স্টোরেজ (হিমাগার) রয়েছে, যেখানে আলুর ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৫ লাখ বস্তা। ব্যক্তিগত হিমাগার থেকে চাষীদের আলু চাষে উদ্বৃদ্ধ করতে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটি বছর বছর ইজারাদার পরিবর্তন হওয়ায় কোন ঋণের ব্যবস্থা করা হয় না। ফলে দিন দিন গুরুত্ব কমতে থাকে।
হিমাগারটি ভবন ও মেশিনারিজ সরঞ্জাম অনেক পুরনো। ভবনটি পুরনো হওয়ায় কোন সংস্কার না হওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। গ্যাস ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গেছে। এমনটি মেশিনটি পুরনো হওয়া বিদ্যুৎ বিল আসে বেশি। একারণে হিমাগারটি ইজারা নিতে তেমন আগ্রহী না বলে জানিয়েছেন ইজারাদাররা।
এদিকে হিমাগারটি বন্ধ থাকায় অনেক সরঞ্জাম মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাঁজা সোসাইটির মূল্যবান সম্পদ এ হিমাগারটি এখন বন্ধের পথে। আগামীতে হিমাগারটি আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।
হিমাগারের প্রহরী (নাইটগার্ড) আব্দুল জলিল বলেন, গত দু' বছর থেকে হিমাগারটি বন্ধ রয়েছে। ভবনে হাওয়া-বাতাস প্রবেশের জন্য দিনে দরজাগুলো খুলে রাখা হয়। যেন ককশিট নষ্ট ও দুর্গন্ধ না হয়। পালা করে দুইজন প্রহরী দায়িত্ব পালন করতে হয়।
হিমাগারের ম্যানেজার আমিনুর রহমান বলেন, গাঁজা সোসাইটির যত সম্পদ রয়েছে তার মধ্যে হিমাগার থেকে ভাল একটা আয়ের উৎস ছিল। ইজারা দেওয়ার জন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। এরমধ্যে করোনা ভাইরাস শুরু হয়। ইজারাদাররা ইজারা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে অর্ধ বছরে (ভাঙা বছর) তারা নিতে আগ্রহী না। বছরের শুরুতে তারা ইজারা নিতে চাই সে হিসেবে আগামী ২০২৩ সালে ইজারা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছি।
নওগাঁ গাঁজা সোসাইটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, হিমাগারটি চালু করতে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সংস্কারের জন্য একটি টেকনিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। যেখানে সংস্কারে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা জানা যাবে। তারা প্রতিবেদন দিলে হিমাগারটি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এক সময় গাঁজা উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে নওগাঁর বেশ সুনাম ছিল। গাঁজার উৎপাদনকে কেন্দ্র করে শহরে গাঁজার চারটি গুদামঘর তৈরি করা হয়েছিল। গড়ে উঠেছে গাঁজা সমবায় সমিতি। ৩৫ বছর আগে গাঁজা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। শহর জুড়ে ব্রিটিশ আমলে গাঁজা সোসাইটির কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এরমধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ের পাশে অবিস্থত 'গাঁজা সমবায় হিমাগার'।
গাঁজা সোসাইটির অফিস এখন দেখভাল করেন অফিস সহকারী আনিসুর রহমান। তিনি জানালেন, সমিতির সম্পত্তির মধ্যে আছে ২৮টি ভবন, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। এসব সম্পদ নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শত বছর ধরে নওগাঁর উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে গাঁজা সোসাইটির এসব সম্পদ।
গাঁজা উৎপাদন বিষয়ে খানসাহেব মোহাম্মদ আফজল এর লেখা 'নওগাঁর মহকুমার ইতিহাস' বই (সর্বশেষ প্রকাশ মে ২০০৭ সাল) থেকে জানা যায়, গাঁজা পাক-ভারতের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্য। গাঁজার গাছ থেকে তিন রকম মাদকদ্রব্য যথা- চরশ, গাঁজা ও ভাঙ্গ পাওয়া যায়। গাঁজা মাড়াইয়ের সময় পা দিয়ে খোঁচানোর তালে তালে নাচের ভঙ্গিতে গান গাইতো- কিয়া চিজ বানাইয়া খোদা/বাংলা দেশকা গাঁজা/এক চিলিম মে জেয়ছা তেয়ছা/দো চিলিম মে উজীর নাজির/চার চিলেম মে রাজা/কিয়া চিজ বানাইয়া খোদা/বাংলা দেশকা গাঁজা।
গাঁজার মতো কৃষিজাত পণ্য পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। এক মণ গাঁজা ৪০০ টাকারও বেশি মূল্যে বিক্রি হয়েছে। নওগাঁর উন্নয়নের মূলে রয়েছে গাঁজা। তবে কোথায় থেকে কতদিন আগে নওগাঁ মহকুমার প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয় তার কোন সঠিক ইতিহাস নেই।
জনশ্রুতি আছে- যশোর থেকে গাঁজার বীজ নিয়ে এসে নওগাঁ ও পাঁচুপুর থানায় (বর্তমানে আত্রাই ও রানীনগর পুলিশ স্টেশন) প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। আবহাওয়া ও জমি চাষে অনুকুল না হওয়ায় পাঁচুপুর থানায় গাঁজা চাষের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
আগে চাষীরা গাঁজা তৈরী করে নিজেরাই বিক্রি করতো। তবে কি পরিমাণ জমিতে গাঁজার চাষ হতো তার সঠিক কোন হিসাব বা তথ্য ছিলো না। ১৮৭৬ সালে লাইসেন্স প্রথা চালু হয়। এর আওতায় নির্দিষ্ট জমি ছাড়া ভিন্ন অন্য কোন জমিতে গাঁজা করতে পারবে না।
সাধারণত জুন-জুলাই মাসে গাঁজা চাষের জন্য চারা তৈরি করে ১ ফুট উঁচু আইলে প্রায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি দূরে দূরে সারিবদ্ধভাবে রোপন করা হতো। ফেব্রুয়ারি মাসে গাঁজা পরিপক্ব হয়। এরপর গাঁজা জটাগুলো সশস্ত্র পুলিশ পাহাড়ায় নওগাঁয় গাঁজা-গোলায় পাঠানো হতো।
১৯২১ সালে নওগাঁ গাঁজা কালটিভেটার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্থাপিত হয়। ওই সময় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজা চাষের প্রচলন ছিল। সরকারি পৃষ্টপোষকতাও দেওয়া হতো। সাত হাজারের বেশি চাষি মিলে প্রায় ১০হাজার হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ করতেন। নওগাঁর গাঁজা চাষিদের পূর্ণবাসনের লক্ষে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পূর্নবাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬ হাজার ৬০০ জন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্য বিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সমবায় সমিতির সদস্যদের পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বিপাকে পড়েন। পরে তারা ধান, সরিষা, সবজি চাষাবাদ শুরু করেন।