প্রতিবেশীরা অপহরণ করে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছে: মরিয়মের মা
খুলনা মহেশ্বরপাশা থেকে নিখোঁজ রহিমা বেগম উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই অনেকটা নিশ্চুপ ছিলেন। প্রথমে মরিয়ম বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে না চাইলেও পরবর্তীতে মরিয়ম তাকে জড়িয়ে ধরলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরে পুলিশের কাছে অপহরণের অভিযোগ করেন রহিমা বেগম।
খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান রহিমা বেগমের করা অভিযোগের কথা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'মেয়েদের সাথে দেখা হওয়ার পরে রহিমা বেগম মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন প্রতিবেশি কিবরিয়া ও মহিউদ্দীনসহ তিন জন তাকে অপহরণ করেছিল। তাকে কোথাও আটকে রেখে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন তারা। পরে তারা এক হাজার টাকা দিয়ে তাকে ছেড়ে দেন।'
'রহিমা বেগমের দাবি, তিনি কিছুই চিনতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে গোপালগঞ্জের মুকছেদপুর হয়ে পূর্ব পরিচিত ভাড়াটিয়ার ফরিদপুরের বোয়ালখালী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে যান। কিন্তু তার কাছে কোনো মোবাইল নম্বর না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি।'
পুলিশ সুপার বলেন, 'আমরা রহিমা বেগমের বক্তব্য খতিয়ে দেখছি। তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আইন অনুযায়ী সবকিছু করা হবে।'
রহিমা বেগমকে উদ্ধারের সময়ে তার কাছ থেকে একটি সাদা ব্যাগ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওই ব্যাগে ওষুধ ছিল, পোশাকসহ অন্যান্য কিছু জিনিস ছিল।
এই ব্যাগের প্রসঙ্গে অবতারণা করে পুলিশ সুপার বলেন, 'একজন ব্যক্তি অপহরণ হলে তার সাথে এগুলো থাকতে পারে না। তাই এটা অপহরণ নাও হতে পারে।'
গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে ফরিদপুরে বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের একটি ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে পৌনে ১১ টায় খুলনার উদ্দেশ্য রওনা হয় পুলিশ। রাত ২ টা ১০ মিনিটে তাকে দৌলতপুর থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাকে রাখা হয় সোনাডাঙায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।
দৌলতপুর থানার উপ পরিদর্শক দোলা দে বলেন, 'ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা অবস্থায় তার মেয়েরা দেখা করতে এসেছিল। তবে তিনি কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। পরে আমার অনুরোধে জানালার কাছে এসেছিলেন। মরিয়ম মা বলে ডাক দিলে তিনি ভিতরে চলে যান। পরে তাকে আমরা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) খুলনা জেলা কার্যালয়ে হস্তান্তর করি।'
পিবিআই কার্যালয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, প্রথমদিকে তিনি নিশ্চুপ ছিলেন।
তবে দুপুরের পরে তার মেয়ে মরিয়মসহ অন্যরা পিবিআই কার্যালয়ে এসে মা রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রহিমা বেগম।
ব্রিফিংয়ে কী জানাল পুলিশ
ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনায় আসা মরিয়ম মান্নানের মাকে উদ্ধার নিয়ে শনিবার গভীর রাতে খুলনার দৌলতপুর থানায় ব্রিফিং করেন মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন।
তিনি বলেন, 'গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম, রহিমা বেগম ফরিদপুরে আছেন। পরে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনারের নির্দেশে আমাদের দক্ষ কিছু কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।'
রহিমার অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছিল না জানিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, 'রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার সকল ডিজিটাল ডিভাইস বন্ধ করে রেখেছিল। তাকে আমরা কোনোভাবেই ট্র্যাক করতে পারছিলাম না।
'গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে যে বাড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই বাড়ির দুই নারীর সঙ্গে তিনি বসে গল্প করছিলেন, তবে আমাদের অফিসাররা তাকে উদ্ধারের পর কোনো কথার জবাব দেননি। সেই থেকে তিনি নির্বাক ছিলেন।'
পুলিশের ভাষ্য, ফরিদপুরের সেই বাড়ি আটক কুদ্দুস মোল্লার, যিনি রহিমাদের খুলনার বাসায় ভাড়া থাকতেন। খুলনা শহরে পাটকলের শ্রমিক ছিলেন কুদ্দুস।
পুলিশ আরও জানায়, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে রহিমার ছেলে মিরাজ একবার কুদ্দুসের বোয়ালমারীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। রহিমাদের সঙ্গে কুদ্দুসের তেমন সম্পর্ক ছিল না।
কুদ্দুসের বাড়ি থেকে তিনজনকে আটকের কথা জানিয়ে কেএমপির কর্মকর্তা মোল্লা জাহাঙ্গীর বলেন, 'ওই বাড়ি থেকে আমরা তিনজনকে হেফাজতে নিয়ে এসেছি। তারা হলেন কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী, ছেলে ও তার (কুদ্দুস) ভাইয়ের স্ত্রী। এই তিনজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, গত ১৭ আগস্ট ওই বাড়িতে রহিমা বেগম গিয়েছিলেন। প্রথমে তারা রহিমাকে চিনতে পারেনি। পরে একপর্যায়ে তাকে চিনতে পারে।
'তখন তাকে সাবেক বাড়িওয়ালা হিসেবে বেশ সেবাযত্ন করেন (কুদ্দুস ও তার বাড়ির লোকজন)। পরবর্তী সময়ে তাদের কাছে (রহিমা) জানান, এর আগে তিনি গোপালগঞ্জের মকছেদপুর ও চট্টগ্রামে ছিলেন।'
রহিমার প্রতিবেশীর অভিযোগ
রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় থানায় আনার পরে মহেশ্বরপাশা থেকে ছুটে আসেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম অভিযোগ করেন, 'মরিয়মের বাবা মান্নান হুজুরের তিনটি বিবাহ ছিল। রহিমা বেগমদের পক্ষ ও আগের একটি পক্ষ স্বামীর মৃত্যুর সূত্রে একই জমি পেয়েছিলেন, তবে রহিমা বেগম অন্য পক্ষকে জমি ভোগ দখল করতে দিতেন না। তাই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের অংশের জমি প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করে দেন। তারপর থেকে কখনোই প্রতিবেশীরা সেই জমি দখলে নিতে পারেনি।'
তিনি বলেন, 'জমি দখল করতে গেলে তারাই (রহিমা বেগমরা) মারামারি শুরু করে। থানা পুলিশ বা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক বছর আগে এ নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তাদের মারামারি হয়েছিল। সেই থেকে স্থানীয় মানুষ তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না।
'ওই দখলে রাখতে তারাই নাটক সাজিয়েছে। আমরা আগেও থানা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। কারণ অন্যদের কেনা জমি তারা দখল করে রাখলেও আদালত একদিন রহিমা বেগমের বিপক্ষে রায় দেবে। সেদিন জমি ছেড়ে দিতে হবে। শুধু জমি দখলছাড়া না করতে তারা এই নাটক সাজিয়েছেন।'
অপহরণের জিডি, মামলা ও সংবাদ সম্মেলন
গত ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে রহিমা নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। রাত সোয়া ২টার দৌলতপুর থানায় অপহরণের অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রহিমার ছেলে মিরাজ আল সাদী।
সে জিডি থেকে জানা যায়, নিখোঁজের সময় রহিমার দ্বিতীয় স্বামী বেল্লাল হাওলাদার বাড়িতে ছিলেন। পানি আনতে বাসা থেকে নিচে নেমেছিলেন রহিমা। দীর্ঘ সময় পরও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মাকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে ২৮ আগস্টে দৌলতপুর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন রহিমার মেয়ে আদুরী।
রহিমা নিখোঁজ হয়েছেন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সোচ্চার হন মরিয়ম মান্নানসহ তার অন্য মেয়েরা।
গত ১ সেপ্টেম্বর খুলনায় সংবাদ সম্মেলন করেন রহিমার বাড়ির লোকজন। সে সময় জানানো হয়, রহিমার সঙ্গে জমি নিয়ে স্থানীয়দের মামলা চলছে। রহিমার করা সেই মামলায় আসামিরা হলেন প্রতিবেশী মঈন উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, রফিকুল ইসলাম পলাশ, মোহাম্মাদ জুয়েল ও হেলাল শরীফ।
আদালত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি পিবিআইতে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর নথিপত্র বুঝে নেয় পিবিআই।