বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি, দুর্বল টাকার ধাক্কায় কঠিন পরিস্থিতিতে আইসিটি
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম সফটওয়্যার অ্যান্ড কনসাল্টিং (প্রাইভেট) লিমিটেড-এর গত ৩১ মে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এএসএ-র সঙ্গে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সার্ভার স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি সইয়ের কদিন পরই কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে ওই কাজে প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যারের ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে আইটি-সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এখন চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ করতে হলে স্পেকট্রামকে প্রথম বাজেটের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হবে।
আরেক ঠিকাদার স্মার্ট টেকনোলজিসও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রায় এক ডজন সরকারি প্রকল্প নিয়ে আটকে গেছে। যেমন, প্রতিষ্ঠানটি কলেজ শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৫-৬ কোটি টাকায় ট্যাবলেট পিসি সরবরাহ করার জন্য চুক্তি করেছিল। কিন্তু বর্তমান খরচে এসব ট্যাব সরবরাহ করতে গেলে তাদের ব্যয় এখন চুক্তিতে ঠিক করা ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যাবে।
মাইক্রোচিপ সংকট থেকে শুরু করে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচের চাপ বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ে সরকারি ও বেসরকারি দুধরনের প্রকল্প সম্পন্ন করা নিয়েই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে বেশিরভাগ আইটি প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
স্পেকট্রাম সফটওয়্যার অ্যান্ড কনসাল্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশফিকুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত ছয় মাসে অনেক হার্ডওয়্যারের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আর আইটি ঠিকাদারদের বেশিরভাগই এই নজিরবিহীন মূলবৃদ্ধির আগেই অর্ডার নিয়েছিল। এ কারণে এখন তারা সেবা ও পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না।
স্মার্ট টেকনোলজিসের পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল বলেন, কোনো সরকারি দপ্তরই বিল সংশোধন করছে না, এবং শত শত প্রকল্প প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
গত মে মাসে তাদের প্রতিষ্ঠান এ অঙ্কের লাভের মার্জিনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে (বিবিএস) ৪০০ প্রিন্টার-কপিইয়ার মেশিন সরবরাহ করার কার্যাদেশ পায়। এর মধ্যে শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ১৮ শতাংশ নিট লোকসানে তারা চালানের প্রথম অংশ সরবরাহ করে।
বাংলাদেশের বাজারে হার্ডওয়্যার সরবরাহকারী অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরভিত্তিক রেডিংটন ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার রেজওয়ানুর জিয়া বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধপূর্ব সময়ের তুলনায় তাদের শিপমেন্ট ৫০ শতাংশের বেসসি কমে গেছে।
রেজওয়ানের ধারণা, বাংলাদেশে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যবসা এখন অন্তত ৪০ শতাংশ কমে গেছে।
একসঙ্গে অনেক বাধা
আইসিটি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গত ছয় মাসে আইসিটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক হার্ডওয়্যারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে ভোক্তারা বাধ্য হয়ে ক্লোন, নন-ব্রান্ডেড হার্ডওয়্যার পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ছয় মাসে মার্কিন ডলারের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশ। এর সঙ্গে বেশি শুল্ক-কর দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হওয়ায় এ খাতের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও স্থানীয় আমদানিকারকদের সেটি ২৫ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হবে। আর বিশ্ববাজারে যে পণ্যের দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে, সেগুলোর জন্য এখন স্থানীয়ভাবে ৭০ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
এদিকে গত মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র) মার্জিন বাড়িয়ে দেয়। এতে আমদানিকারকদের ব্যয় আরও বেড়ে গেছে।
বর্তমানে আইসিটি আমদানিকারকদের এলসির মূল্যের ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি নগদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, বাকি ২৫ শতাংশের নিশ্চয়তা দিচ্ছে ব্যাংক। অথচ ছয় মাস আগেও আমদানিকারকরা এলসির মূল্যের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারতেন।
বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই যখন বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। ছোট কোম্পানিগুলো এখন এলসি খুলতে পারে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া সরকার এ বছর আমদানিকৃত ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের ওপর মূল্য সংযোজন করও (ভ্যাট) বাড়িয়েছে।
আইটি ও আইটিসংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচ সংগঠন সরকারের কাছে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানালেও এখনও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) ভাইস প্রেসিডেন্ট রাশেদ আলী ভুঁইয়া।
রাশেদ আলীর প্রতিষ্ঠান স্টার টেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তথ্যানুসারে, গত ছয় মাসে ল্যাপটপের দাম বেড়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ, আর ক্লোন পিসির দাম বেড়েছে ১৫-২৫ শতাংশ।
স্টার টেকের রিটেইল ডিরেক্টর মো. জাহেদ আলী ভূঁইয়ার হিসাবে গত ছয় মাসে ল্যাপটপ সেগমেন্টে বিক্রি কমেছে ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে ক্লোন ডেস্কটপ পিসির দাম ধীরে বেড়েছে, সেইসঙ্গে ক্রেতারাও এ পিসির ক্রয় বাড়িয়েছে। ফলে ক্লোন পিসির বিক্রি হ্রাসের হার আরেকটু ধীর—১৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, মহামারির সময় মানুষ খুব দ্রুত ডিজিটাল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন তীব্র মূল্যস্ফীতির চাপে পড়া ভোক্তারা নিজেদের পছন্দসই ডিভাইস কিনতে বেগ পাচ্ছেন। দেশের আইসিটি হার্ডওয়্যারের বাজার ১ বিলিয়ন ডলারের বলে জানান তিনি। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের ক্রেতা ব্যক্তি পর্যায়ে ভোক্তারা, বাকি ৪০ শতাংশের ক্রেতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
বেসিসের সাবেক সভাপতি টেক উদ্যোক্তা একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, ডিভাইসের ক্রমবর্ধমান দাম দৃশ্যত ডিজিটাল বিভাজন উসকে দিচ্ছে, যা হতে দেওয়া উচিত না।
আমদানি করা সফটওয়্যারের দামও বেড়েছে
মুশফিকুর রহমান জানান, দেশের সফটওয়্যার বাজারের আকার ৬০০ মিলিয়ন ডলার। এ বাজারের বেশিরভাগই চাহিদাই পূরণ করে স্থানীয় শিল্প। তবে বার্ষিক চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখনও আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়।
এতদিন আমদানিকৃত আমদানিকৃত কিছু সফটওয়্যারের ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। কিন্তু চলতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সব ধরনের সফটওয়্যারের আমদানি মূল্যের ওপর ৫৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
'বিশ্ববাজারে সফটওয়্যারের দাম না বাড়াতেই রক্ষা,' বলেন মুশফিকুর।
তবে ডলারের চড়া মূল্য এবং শুল্ক ও করের পরিমাণ হঠাৎ বেশি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমদানিকৃত সফটওয়্যারের দাম দ্রুত বেড়ে গেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য এসব সফটওয়্যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিপাকে ঠিকাদারেরা
সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে পণ্য ও সেবা সরবরাহকারী আইসিটি ঠিকাদারেরা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখে পড়েছে।
বেসিসের প্রেসিডেন্ট রাসেল টি আহমেদ বলেন, কোনো ঠিকাদারের পক্ষেই ৮৬-৮৭ টাজা ডলারের মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব না। কেননা তাদেরকে এলসি নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে প্রতি ডলারে ১০৬-০৭ টাকা মূল্যে।
বেসরকারি প্রকল্পগুলো অবশ্য মূল্য সংশোধনের অনুরোধে কিছুটা সাড়া দিচ্ছে বলে জানান বিসিএস পরিচালক জহিরুল ইসলাম।কিন্তু সরকারি প্রকল্প থেকে সেরকম সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
যোগাযোগ করা হলে আইসিটি বিভাগের সচিব এনএম জিয়াউল আলম বলেন, 'পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা অবগত। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষরা আমাদের কাছে এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।'
তিনি বলেন, সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আইসিটি বিভাগের নেই, তবে তারা সংশ্লিষ্ট খাতের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।
খুচরা বিক্রি এখনও চলছে
প্রকল্প ঠিকাদারদের ধারণা, নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ও নিরাপত্তা হার্ডওয়্যারসহ হার্ডওয়্যার বাজারে বিক্রির পরিমাণ ৪০-৪৫ শতাংশ কমে গেছে। সফটওয়্যারের বাজারেও বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে ধীর হয়ে গেছে।
তবে খুচরা বিক্রির অবস্থা এখনও তুলনামূলক ভালো। কারণ ব্যক্তি খাতের ক্রেতারা যেকোনো মূল্যে তাদের দরকারি কম্পিউটার কেনার চেষ্টা করেন।
দেশের জনপ্রিয় কম্পিউটার রিটেইলিং চেইন রায়ানস কম্পিউটারের পিসি বিক্রি প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে। তবে তারা এটি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। তারা এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ হাসান।
বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ম্যাক্রোইকোনমি খাতে এখন একটি বাস্তব সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি তৈরির সবচেয়ে বড় শিল্প আইসিটি ও আইটিইএস। তাই সরকারের উচিত এ শিল্পের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
সুবিধাজনক এলসি মার্জিন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে এবং প্রকল্পের ব্যয় সংশোধনের কথা বিবেচনা করতে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনোলজি ইউনিটকে চিঠি দিয়েছে তার সংগঠন।