গাজীপুর-চন্দ্রার দুঃসহ যানজট এখন রূপ নিয়েছে স্বস্তির যাত্রায়
রাজধানীর মগবাজার থেকে গাজীপুরে মাত্র ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে পৌঁছে গেছেন! ফোনের স্ক্রিনে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রাইডশেয়ারিং সেবাদাতা মো. জাবেদ হোসেন।
অথচ এই রুটে অধিকাংশ সময় লেগে থাকে প্রচণ্ড যানজট- মগবাজার থেকে আসতে হলে লাগে অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু শনিবার বিকেলে জাবেদের জন্য বিস্ময়ই অপেক্ষা করছিল।
তিনি যেন আনমনেই বলে ফেললেন, 'আজ ঘটনা কী? সব অটোগুলোই বা কই গেল?'
সেদিন সন্ধ্যাতে একই কথা ভেবে অবাক হচ্ছিলেন, টঙ্গীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সংলগ্ন একটি নির্মাণ প্রকল্পের শ্রমিক।
আগে এই রাস্তায় যেখানে-সেখানে থেমে যাত্রী ওঠানামা করতো বাসগুলো। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস থামাতে না পেরে তিনি বললেন, 'হঠাৎ এই রাস্তার কী হলো–বুঝতে পারছি না। তবে মনে হয়, কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন'।
স্থানীয়রা এর কৃতিত্ব দিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধ করা এবং ট্রাফিক আইনভঙ্গকারীদের ধরতে তাদের টহল বৃদ্ধির ঘটনাকে।
তারা বলছেন, গত ১৩ জুলাই মোল্লা নজরুল ইসলামকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার পদে নিয়োগদানের একদিন পর থেকেই সড়কে ট্রাফিকের এই 'নাটকীয় পরিবর্তন' এর সূচনা।
দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার আগে জিএমপির নতুন কমিশনার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, তিনি প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর তালিকা করেছেন। এই তালিকায় অগ্রাধিকারে রেখেছেন, ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়কের ২৫ কিলোমিটার এলাকার বিভীষিকাসম যানজটের অবসান।
রাজধানী থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গাজীপুর-বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের উত্তরপশ্চিমের জেলাগুলোর সাথে পরিবহনের গেটওয়ে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় রয়েছে রপ্তানিমুখী অজস্র পোশাক কারখানা ও অন্যান্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিমও জিএমপির এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আন্তরিক হলে পুলিশও চেঞ্জমেকার হতে পারে এ ঘটনা তাই প্রমাণ করে।'
মোল্লা নজরুল ইসলামের অন্তত চারজন পূর্বসূরি হাইওয়েতে ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক প্রবেশ বন্ধ করেছিলেন। তবে তাদের উদ্যোগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিন চাকার বাহনগুলো ফিরে আসায় সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছিল বলে ট্রাফিক তথ্যসূত্রে জানা গেছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকার একজন রিক্সাচালক মো. শামীম আলম বলেন, 'হাইওয়ে থেকে অটোরিক্সা তুলে দেওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমে গেছে'।
সময়ই যখন অর্থ
মোবাইল ফোন ব্র্যান্ড অপ্পো'র ফ্যাক্টরি হেড রেমন্ড চ্যান জানান, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে তারা এখন সহজেই কাঁচামাল তাদের গাজীপুরের কারখানায় আনতে পারছেন। সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মাত্র ৪৫-৫০ মিনিটেই রাজধানীতে যাতায়াত করতে পারছেন তারা।
'পুলিশই এটা সম্ভব করেছে', বলেন তিনি।
স্টাইলিশ গার্মেন্টস লিমিটেডের সিইও রোহান দামাইকা বলেন, 'আগে যানজটের কারণে বিদেশি বায়াররা সহজে তাদের গাজীপুরের কারখানা পরিদর্শনে আসতে চাইতেন না। কিন্তু এখন এই রুটের দৃশ্যপট যেন আমূল বদলে গেছে।'
উত্তরবঙ্গগামী একটি বাসের কন্ডাক্টর খায়রুল আলম বলেন, ঢাকা-চন্দ্রা হাইওয়ে পাড়ি দিতে আগে ২-৩ ঘণ্টা লেগে যেত। কিন্তু এখন এই দূরত্ব তারা মাত্র ৩০-৪৫ মিনিটে অতিক্রম করতে পারেন।
জিএমপির তথ্যমতে, প্রতিদিন এই ২৫ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দেয় অন্তত ৫০ হাজার যানবাহন।
মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, এই পরিমাণ বাহন মাত্র ৩০ মিনিট যানজটে আটকে থাকলেই তাতে বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি অপচয় হতো।
যানজটে নষ্ট হওয়া কর্মঘণ্টা বেঁচে যাওয়া এবং অটোরিক্সা চার্জে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমায় হওয়ায় তিনি অনুমান করছেন, থ্রি-হুইলার মুক্ত হাইওয়ে বছরে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোরও মূল্য আছে
মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন তারা অন্তত ২০-৩০টি অটোরিক্সা আটক করে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পাঠাচ্ছেন। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধ করা হলেও অন্যান্য সড়ক ও লেনে চলাচলকারী অটোরিক্সা ধরছে না পুলিশ।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় ৬ হাজার থ্রি-হুইলার জব্দ করে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েছে গাজীপুর পুলিশ।
রিক্সা মালিকদের স্থানীয় একটি সমিতির নেতা রুহুল আমিন বলেন, তিন চাকার এসব বাহন চালিয়ে গরিব চালকদের জীবিকা নির্বাহ হয়, এজন্য তারা পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদ করছেন।
'যে ৬ হাজার পরিবারের রিক্সা জব্দ করা হয়েছে, শুধু তারাই পুলিশি তৎপরতার নিষ্ঠুরতা বুঝতে পারছে', মন্তব্য করেন তিনি।
রিক্সাচালকদের পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই ডাম্প ইয়ার্ডে এসে তাদের রিক্সা ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। ডাম্প ইয়ার্ডের সামনে কোলে বাচ্চা নিয়ে এমনই এক নারীকে কাঁদতে দেখা যায়।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, 'আমার স্বামী একটু অসুস্থ। পরিশ্রমের কাজ তেমন পারে না। তাই সংসার চালানোর জন্য ধারদেনা করে একটা ইজিবাইক কিনে দিয়েছিলাম একমাস আগে। গাড়ি ধরার পর থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। ঘরে এক কেজি চালও নেই। এখন কি করব ভেবে পাচ্ছি না'।
জব্দ করার বদলে প্রথমে ব্যাটারিচালিত রিক্সা আমদানি ও বিক্রি বন্ধের দাবি করেন তিনি।
'তারপর নাহয় আপনি আইন অমান্যের অপরাধ খুঁজবেন। তা না করে হঠাৎ করেই অভিযান চালাতে পারেন না। মানুষের তিল তিল করে জমানো টাকা ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকিয়ে এখন আমাদের আদালতের আদেশের কথা বলছেন'।
২০১৭ সালে দেওয়া এক রায়ে, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার যান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে রুহুল আমিন জানান, জব্দ করা রিক্সা ফেরত পেতে তারা হাইকোর্টে একটি রিট করেছেন।
মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, পুলিশ অটোরিক্সা চালকদের স্থানীয় পোশাক কারখানায় চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তারা এতে সাড়া দেয়নি।