নতুন যন্ত্রপাতির সাথে বাড়লো গতি, বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষা ছাড়াই জেটিতে ভিড়ছে জাহাজ
আমদানি পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে ২০২১-২২ অর্থবছরে একটি কন্টেইনার জাহাজকে ২.২৪ দিন বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষা করতে হতো। তারপর চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বার্থিং পেতো। আর জেটিতে পণ্য খালাস এবং রপ্তানি পণ্য বোঝাই করতে সময় লাগতো ৩ দিন বা ৭২ ঘণ্টা।
এখন বন্দরের জেটিতে ভিড়তে কোন কন্টেইনার জাহাজকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। বহির্নোঙ্গরে আসার সাথে সাথে জাহাজ ভিড়ছে জেটিতে। শুধু তাই নয়, জেটিতে জাহাজ ভেড়ার পর আমদানি কন্টেইনার খালাস এবং রপ্তানি পণ্য খালাস করতে সময় লাগছে ২ দিন।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ দিনের মধ্যে মাত্র তিন দিন বহির্নোঙ্গরে একটি করে কন্টেইনারবাহী জাহাজ বার্থিং এর অপেক্ষায় ছিলো। বাকি ১২ দিন প্রতিটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি বন্দরের নির্দিষ্ট জেটিতে গিয়ে পণ্য খালাস করতে পেরেছে।
গত ১৫ দিনের মাত্র চার দিন একটি করে বাল্ক কার্গো বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষায় ছিল। বাকি ১১ দিন সরাসরি জেটি বার্থিং পেয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চলমান ডলার সংকট, এলসি মার্জিন বৃদ্ধি, বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি সহ বিভিন্ন কারণে কমেছে আমদানির পরিমাণ। তবে এখনো স্বাভাবিক আছে বন্দরে জাহাজ আসার সংখ্যা। কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে নতুন যন্ত্রপাতি যোগ হওয়ায় জাহাজ থেকে কন্টেইনার উঠানামায় আগের তুলনায় সময় কম লাগছে অন্তত ২৪ ঘণ্টা।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দর পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৪৪ টিইইউস কন্টেইনার। জুলাইতে হ্যান্ডেল করে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ টিইইউস। এক মাসের ব্যবধানে আমদানি পণ্যের কন্টেইনার কমে যায় ১৬ হাজার ৩৪৭ টিইইউস।
২০২২ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসে ৩৩৮টি, জুলাইতে আসে ৩৪২টি। এর আগে ২০২১ সালের জুনে ৩০৫টি এবং জুলাইতে ২৯১টি জাহাজ এসেছিলো।
চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২১ সালে জাহাজ এসেছিলো ৪ হাজার ২৩১টি। এবং কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং হয়েছিলো ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮টি।
সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন বহির্নোঙ্গরে কোন জাহাজ বার্থিং এর অপেক্ষায় নেই। জাহাজগুলো অন এরাইভাল বার্থিং পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ৪টি কোয়ে গ্যান্ট্রি ক্রেন সহ নতুন যন্ত্রপাতি যুক্ত হওয়ার ফলে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে সক্ষমতা আরো বেড়েছে। ইয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে গতি এসেছে। বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেনার রাখার স্পেস ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউস থেকে বাড়িয়ে ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউস করা হয়েছে। ফলে জাহাজের ওয়েটিং টাইম কমে আসায় বড় ধরনের সাফল্য এসেছে।
তিনি আরো বলেন, বন্দরের আমদানি পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাসে আমদানি কন্টেইনারের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে জাহাজ আসার পরিমাণ স্বাভাবিক রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামার কাজে মোট তিনটি টার্মিনাল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)। তিনটি টার্মিনালে ১৯টি জেটি রয়েছে। এর মধ্যে কন্টেইনার জেটি ১৩টি, বাকি ৬টি জেনারেল কার্গোর জন্য। এনসিটি এবং সিসিটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ারটেক।
সাইফ মেরিটাইমের সিওও (চিফ অপারেটিং অফিসার) আবদুল্লাহ জহির টিবিএসকে বলেন, নতুন যন্ত্রপাতির ফলে আমরা আগের চেয়ে কম সময়ে জাহাজে কন্টেইনার উঠানামা করতে সক্ষম হচ্ছি। কন্টেইনার খালাস এবং জাহাজীকরণে ১ দিন সময় সাশ্রয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, একটি জাহাজ বন্দরে এক দিন বেশি সময় থাকলে জাহাজ ভাড়া বাবদ ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার ডেমারেজ দিতে হতো শিপিং এজেন্টদের। ওয়েটিং টাইম কমে যাওযায় এখন আর এই ডেমারেজ দিতে হবেনা শিপিং এজেন্টদের। এতে আমদানি পণ্য মূল্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, সম্প্রতি বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের জন্য ১৬টি যন্ত্রপাতি বন্দরে যুক্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কোয়ে গ্যান্ট্রি ক্রেন ৪টি, রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন ৬টি, মোবাইল ক্রেন (১০০ টন) ২টি, মোবাইল ক্রেন (৫০ টন) ২টি এবং কন্টেইনার মুভার ২টি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পৌঁছবে আরও ১৯টি ইকুইপমেন্ট।
জাহাজ থেকে কন্টেইনার উঠানামার প্রধান ইকুইপমেন্ট হচ্ছে কোয়ে গ্যান্ট্রি ক্রেন। নতুন চারটি যুক্ত হওয়ায় বন্দর জেটিতে এখন এই ইকুইপমেন্ট রয়েছে ১৮টি এবং রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনের সংখ্যা ৪৯।
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারবাহী আমদানি পণ্য আসে চীন সহ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, কলম্বো, পোর্টকেলাং, তানজুম পেলিপাস বন্দর হয়ে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জাহাজ পরিচালনাকারী শিপিং ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে আমদানি পণ্যের মজুত কমে গেছে।
বন্দর থেকে কলম্বো রুটে ৪টি এবং সিঙ্গাপুর-পোর্টকেলাং রুটে ২টি সহ ৬টি কন্টেইনারবাহী ফিডার ভ্যাসেল পরিচালনা করে কর্ণফুলি গ্রুপের এইচআর লাইন। এসব ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর থেকে গড়ে ১৫০০ টিইইউস আমদানি পণ্য পরিবহন করলেও জাহাজ প্রতি বুকিং থাকতো প্রায় ২ হাজার টিইইউস। এখন বুকিংয়ের সংখ্যা কমে গেছে জাহাজ প্রতি ৫০০ টিইইউস।
এইচ আর লাইনের নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা বলেন, আমদানি ভলিউম আগের তুলনায় কমে গেছে। আগে প্রতি জাহাজে গড়ে দেড় হাজার আমদানি পণ্যবাহী কন্টেইনার আসলেও এখন তার পরিমাণ ১০ শতাংশ কমে গেছে।