বারবার সতর্ক করার পরেও কর্ণপাত করেনি বিআরটি
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এর দুই চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট এবং সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ সংস্থার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়ে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও তারা কোনরূপ কর্ণপাত করেনি।
জুলাই মাসে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল পিটিওয়াই এন্ড এসোসিয়েটস এর দাখিল করা অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব রয়েছে। দফায় দফায় নির্দেশনা আসলেও ঠিকাদারের পক্ষ থেকে কর্মীদের কাজের সুরক্ষা উপাদান যেমন সেফটি হারনেস, ফেস শিল্ড, গ্লাভস এবং গগলস সরবরাহ করা হচ্ছে না।
তাছাড়া রাস্তার মাঝে নির্মাণ উপকরণ ফেলে রাখায় বড় ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা করা হয় প্রতিবেদনে। এর আগে ২০২০ সালে প্রকল্পটি পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে বড় ধরনের প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রকল্প এলাকায় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৪ মার্চ গার্ডার ধসে ৬ জন আহত হওয়ার পরদিন আব্দুল্লাহপুরে পিয়ার ক্যাপ খুলে পড়ে। চলতি বছরের ৯ জুলাই গাজীপুরের চান্দনায় গার্ডার চাপায় একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ২ জন আহত হয়।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও ঠিকাদারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদাসীনতা আর অব্যস্থাপনার ধারাবাহিকতায় এবার প্রাণ হারালো পাঁচ জন।
২০১৬ সালের মধ্যে নির্মাণ শেষ করতে ২০১২ সালের শেষের দিকে নেয়া বিআরটি প্রকল্পে বাড়তি পাঁচ বছর শেষ হলেও কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি মূলত চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অনাগ্রহের কারণে। আর বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো দফায় দফায় সময় বাড়ানোর কারণে ২২২৮.৪৭৫৪ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৪২৬৮.৩২ কোটি টাকায় উঠেছে।
২০২০ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুর্বল প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রণয়ন ও বিস্তারিত নকশায় ত্রুটি থাকায় বারবার নকশা পরিবর্তন এবং মাঝপথে এসে উপকরণের যোগ-বিয়োগ ও আকৃতির পরিবর্তন করা হয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনায় সময়মতো কাজ শেষ হলে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দরে মাত্র ২০ মিনিটে যাতায়াত সম্ভব হতো। এক ঘণ্টায় এ রাস্তায় যাত্রী পরিবহন করা যেত প্রায় ২৫ হাজার।
বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি পর্যবেক্ষণ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঠিকাদারের চরম উদাসীনতার প্রমাণ পায় আইএমইডি। নির্মাণ চলাকালীন সময়ে সড়কে চলাচলকারী যানবাহন, পথচারী ও নির্মাণ যন্ত্রপাতির জন্য অনুমোদিত সাইন, সিগন্যাল ব্যারিকেড স্থাপন ও নির্মাণ কর্মীদের জন্য যথাযথ সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহের সুপারিশ দিলেও তা পরিপালন করা হয়নি।
পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিকাদারের অনীহার কারণে এক দশকের বেশি সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি বলে মনে করে আইএমইডি। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুযায়ী জনশক্তি নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করছে না।
তাছাড়া দুই প্রতিষ্ঠানই প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থও সরবরাহ করতে পারছে না। এই অবহেলার কারণে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলেও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগই নেয়নি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
৮৫৫.৩৭৫ কোটি টাকায় ১৬ কিলামিটার সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি ছয় ফ্লাইওভার, ১৯ বিআরটি স্টেশন নির্মাণ ও ড্রেন নির্মাণের কাজ করছে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি)। সড়ক বিভাগের প্রাক্বলনে এ খাতে ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও ৬.৫২% কম ব্যয়ে কাজটি নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ৯১৭ দিনের মধ্যে কাজ হস্তান্তরের কথা থাকলেও পরে তা ১১৬৪ দিনে বাড়ানো হয়। এ সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আরও ৪৮০ দিন সময় চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
৯৩৫.১২৯৭ কোটি টাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার উড়ন্ত সড়ক নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ পেয়েছে চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন এবং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (জেটিইজি)। ১২৮৮ কোটি টাকার এই কাজ ২৭.৩৯% কম দামে নিয়ে কাজ ঝুলিয়ে রাখছে ঠিকাদার। চুক্তির সময়সীমার ৯১৭ দিন পার হয়ে গেলেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি না থাকায় এ ঠিকাদারও বাড়তি সময় চেয়েছে।
শুরুতেই গলদ
রাজধানী ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৫ সালে প্রণয়ন করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) বিমানবন্দর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন-৩ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। এই সুবিধা ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দিতে গাজীপুর পর্যন্ত প্রকল্পটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয় পরবর্তীতে।
এডিবির সহায়তায় নেয়া আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সুপারিশে গাজীপুর-বিমানবন্দর সড়কে প্রথমেই বিআরটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।
এই সুপারিশের আলোকে ২০.৫ কিলোমিটার ডেডিকেটেড বাস করিডোর নির্মাণের লক্ষ্যে এডিবির আর্থিক সহায়তায় ২০৩৯.৮৪৮৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি) শীর্ষক প্রকল্প নেয়া হয় ২০১২ সালে। পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতার কারণে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ হয়। একই ধরনের সঙ্কটের পুনরাবৃত্তি এড়াতে বিমানবন্দর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বিআরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
দফায় দফায় ডিজাইন সংশোধন
সম্ভাব্যতা যাচাই আর প্রকল্প নকশায় দুর্বলতার কারণে দফায় দফায় বিআরটি প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। মূল প্রকল্পে ২.৮১ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা থাকলেও সংশোধনীতে তা ৫.০৭ কিলোমিটারে উঠেছে। চারটি ফ্লাইওভার চার লেনের পরিবর্তে করা হবে ছয় লেনে। এর মধ্যে গাজীপুর চৌরাস্তার ফ্লাইওভারের নকশায় ত্রুটি পাওয়া গেছে।
সাড়ে তিন কিলোমিটার উড়ন্ত সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীতে তা সাড়ে চার কিলোমিটারে উন্নীত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক নির্মাণে ফুটপাতের ব্যবস্থা না থাকায় তা যোগ হয় সংশোধনীতে। সড়কের দুই পাশে ধীরগামী গাড়ির জন্য পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণের কাজটিও যুক্ত হয় পরবর্তীতে।
মাঠে নামতেই পাঁচ বছর
অনুমোদনের পরের বছর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। বিস্তারিত নকশা, বিভিন্ন কাজের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া শেষ করতেই চলে যায় লম্বা সময়। সব প্রক্রিয়া শেষে ঠিকাদারের সঙ্গে প্রথম চুক্তি হয় ২০১৬ সালের শুরুতে। আর সর্বশেষ প্যাকেজের চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। এ হিসাবে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হতেই চলে যায় পাঁচ বছর। এর আগেই প্রকল্পের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যায়।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, প্রকল্পের ডিজাইনে বড় ধরনের অপূর্ণতা ও ভুল ছিল।
তিনি বলেন, ব্যস্ত একটা এলাকায় ফুটপাতের কোন বিকল্প নেই। আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেম রাখতেই হবে। বিআরটির পাশের সড়কের পরিবহন কীভাবে চলাচল করবে তারও ব্যবস্থা রাখতে হবে।
শুরুতে এ সব বিষয়ে নজর না দিয়ে পরে যোগ-বিয়োগ করায় প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে নির্মাণ কাজ পরিচালনার এমন নজির পৃথিবীর আর কোন দেশেই পাওয়া যাবে না। সামান্য কিছু খরচ বাঁচাতে ঠিকাদাররা মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলছেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অর্থ ও লোক সংকট রয়েছে। ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়নি। অবশ্য দুর্ঘটনার দায় বিআরটি কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না বলেও মনে করেন তিনি।
যাদের অদক্ষতা বা অবহেলার কারণে আগে এই প্রকল্পে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তবে সোমবারের দুর্ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দেরিতে হলেও টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের।
এদিকে সড়কে আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, পরে আবারো কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
দুর্ঘটনাপ্রবণ নির্মাণাধীন প্রকল্প
প্রকল্প পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল পিটিওয়াই এন্ড এসোসিয়েটস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এই রুটে প্রতিদিন মোট ৪৫,৪৯৩টি যানবাহন চলাচল করে; ফলে যানজট এবং সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে।
নির্মাণ শুরুর আগেই বিশদ নকশা নির্ণয় পর্যায়ে, পরামর্শ সংস্থা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (টিএমপি) হালনাগাদ এবং বাস্তবায়নের উপর জোর দেয়।
প্রকল্পটির সুবিধা এবং সময়সীমা সম্পর্কে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে মিলে জনসাধারণকে অবগত করার জন্য নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ করা হয় প্রতিবেদনে।
স্থানীয় ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে সড়কের যাত্রীদের যেন কোন অসুবিধায় না পড়তে হয়, নির্বিঘ্ন যান চলাচল নিশ্চিত হয় এবং প্রকল্প কার্যক্রমের জন্য দুর্ঘটনা বা যানজট সৃষ্টি না হয় সেজন্য উপযুক্ত ট্রাফিক ডাইভারশন স্কিম বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।
এছাড়াও মোটা হরফে (বোল্ড) ডাইভারশন সাইন স্থাপনের কথা বলা হয়, যেন রাতেও তা সহজে চোখে পড়ে। নির্মাণ এলাকার আশেপাশে চলাচলকারী যানবাহন এবং পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করতে ফ্ল্যাগ পারসন বা পতাকাধারী ব্যক্তিদের উল্লেখও করা হয়।
তবে এ সব নিয়মের খুব সামান্যই পরিপালন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন।