প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের

কক্সবাজারের ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সব দাবি পূরণ করে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আশ্বাস দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট।
মনগড়া প্রত্যাবাসন করা যাবে না বলে মিশেল ব্যাচলেট প্রত্যাবাসনের জন্য ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করেন রোহিঙ্গাদের।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) ৪ ঘন্টার সফরে মিশেল ব্যাচলেটের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রত্যাবাসন, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা সহ নানা বিষয়ে অবহিত হন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ ও তরুণদের সঙ্গে কথা বলেন একান্ত বৈঠকে।
মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৯ টায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি উখিয়ার মধুরছড়াস্থ ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইউএনএইচসিআর এর রেজিস্ট্রেশন সেন্টারে পৌঁছালে তাদের স্বাগত জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত।
সেখানে মিশেল ব্যাচলেট সহ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ১০ মিনিটের মত অবস্থান করে রোহিঙ্গাদের রেজিস্টেশন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর বৃষ্টির মধ্যে তিনি ওই ক্যাম্পের ইউএনএইচসিআর এর ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের কার্যক্রম পরিদর্শনে যান। সেখানেও তিনি ১০ মিনিটের মত অবস্থান করে ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বরত সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করেন।
এরপর সকাল ১০ টায় চার নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি-ব্লকের ওমেন সেন্টারে পরিদর্শনে যান। এসময় সেখানে ২০ জন নারীর সঙ্গে লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা এবং ক্যাম্পের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
প্রতিনিধি দলটি লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা এবং ক্যাম্পের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চান। নারীরা প্রতিনিধি দলটিকে অবহিত করেন বর্তমানে ক্যাম্পে লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা আগের চেয়ে কমেছে। নারীদের অপহরণ করে ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন কমেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরো বাড়ানোর দাবি জানান তারা।

এদিকে সকাল সাড়ে ১০ টায় চার নম্বর বর্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্র্যাকের কমিউনিটি সেন্টার পরিদর্শনে যান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি দলটি। সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও ক্যাম্পের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে ৯ জন ধর্মীয় নেতা এবং ৯ জন যুবকের সঙ্গে আলাপ করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
আলোচনায় অংশ নেওয়া মৌলভী নাজির আহমদ জানান, প্রতিনিধি দলটিকে মিয়ানমারের পরিস্থিতির উন্নয়ন, রোহিঙ্গা অধিকার নিশ্চিত হলে স্বদেশে ফেরত যাওয়ার আগ্রহের কথা অবহিত করেন। বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করে দ্রুত প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান। তার প্রেক্ষিতে মিশেল ব্যাচলেট মনগড়া প্রত্যাবাসন করা যাবে না এবং দাবি-দাওয়া পূরণের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন হবে বলে আশ^াস দেন। একই সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য ধৈর্য্য ধরতেও বলেন মিশেল ব্যাচলেট।
যুবক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, প্রতিনিধি দলটিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। ক্যাম্প কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ অপরাধির তৎপরতা, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপন আদায়, মাদক ব্যবসা সহ সার্বিক পরিস্থিতির কথা প্রতিনিধিদের জানানো হয়। কিছু চিহ্নিত অপরাধি চক্র এমন অপকর্মে জড়িত থাকার বিষয় অবহিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানানো হয়।
প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে আলাপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় নেতা হাফেজ রশিদ আহমদ বলেন, প্রত্যাবাসনের চলমান প্রক্রিয়ায় স্বদেশে নাগরিক অধিকার নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গারা এখনো আশ্বস্ত হতে পারেনি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এর তত্ত্বাবধানে ছাড়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরবে না।
পরে সকাল সোয়া ১১ টায় মিশেল বেসলেটের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ২০ নম্বর বর্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর বৃক্ষরোপন কর্মসূচী পরিদর্শনে যান। সেখানে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। পরে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতবিনিময় করেন।
সবশেষে বেলা সাড়ে ১২ টায় ৪ নম্বর বর্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লার্নিং সেন্টার পরিদর্শনে যান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সেখানে রোহিঙ্গা শিশু ও শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন।
এরপর দুপুর ১ টায় মিশেল বেসলেটের নেতৃত্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারের উদ্দ্যেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ত্যাগ করেন। প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার পৌঁছে দুপুর ২ টা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
প্রতিনিধি দলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচলেট ছাড়াও ওএইচসিএইচআর এর হেড অব এশিয়া প্যাসিফিক সেকশনের রোরী মংগুভেন ও এইচসিএইচআর এর মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি, ওএইচসিএইচআর এর গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি এভারেট হেডলি, ইউএনআরসিও এর ঢাকাস্থ জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান ও জাতীয় মানবাধিকার কর্মকর্তা জাহিদ হোসাইন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে বৈঠক শেষে বিকাল ৪ টায় বিমান যোগে ঢাকায় ফিরেছেন মিশেল ব্যাচলেটের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের এ প্রতিনিধি দল। বুধবার ঢাকায় প্রেসব্রিফিং করার কথা রয়েছে প্রতিনিধি দলের।