জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি: চাপ বাড়ছে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে এবার ঢাকার বাজারে চাল, ডিম, ব্রয়লার মুরগি, আটার মত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে করে আগে থেকেই চাপে থাকা সীমিত আয়ের মানুষগুলোর দৈনন্দিন খরচের উপর চাপ আরও বেড়ে গেছে।
দিনাজপুর, নীলফামারির চালকল মালিক ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ টনের যে ট্রাকগুলো আগে ঢাকায় আসতো ১৫-১৬ হাজার টাকার সেগুলোর ভাড়া বেড়ে এখন ২২-২৪ হাজার টাকা হয়েছে।
একইসঙ্গে লোডশেডিং এর কারণে মিলাররা বেশি চাল উৎপাদন করতে পারছে না। ফলের চালের প্রোডাকশন কমে গেছে এবং পাইকারী বিক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দিতে পারছে না তারা।
এই সময়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মিলাররা মানভেদে বিভিন্ন চালের ৫০ কেজির বস্তায় দাম ৫০-১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ঢাকার বাজারে।
চালের পাইকারী বিক্রেতা মো. সজিব টিবিএসকে জানান, "প্রোডাকশন কষ্ট, গাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন কারণে মিলগেটে দাম বেড়েছে, যে কারণে আমরাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।"
ঢাকার বাজারে এখন বিআর-২৮ চাল পাইকারীতেই ২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিল ২৪৫০-২৫০০ টাকা। অর্থাৎ পাইকারীতেই প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৫২ টাকা, যা খুচরায় বাজার ভেদে আরও ৪-৬ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ানবাজারের বাদশা রাইস এজেন্সিতে গিয়ে দেখা গেল বোর্ডে সবচেয়ে ভালো মানের নাজিরশাইল চাল পাইকারীতে বিক্রি হচ্ছে ৭৮ টাকায়, খুরচায় যা ৮২-৮৩ টাকা। মোটা চালের দামও এখন ৫২-৫৩ টাকা।
এই বাজারে চাল কিনতে আসা আরিফুর রহমান জানান, "মিনিকেট চাল ৭০ টাকার নিচে পাওয়া মুশকিল। বাধ্য হয়েই কম দামি চাল খাওয়া শুরু করেছি, আজকে ২৮ জাতের চাল কিনলাম, তাও বাড়তি দাম দিয়ে।"
চালের পাশাপাশি ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৫৫-১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে ডিমের দামও। ১২০ টাকা ডজন হিসেবে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম এখন ১৩৫-১৪০ টাকা।
তেজগাঁওয়ে ব্রয়লার মুরগির পাইকারী বিক্রেতা মো. মাসুম টিবিএসকে জানান, "তেজগাঁওয়ের আড়তে মূলত উত্তরাঞ্চল থেকে মুরগি আসে বেশি। আগে যেখানে গাড়িভাড়া ছিল ২০-২২ হাজার টাকা এখন সেটা ২৫-২৭ হাজার টাকা হয়ে গেছে।"
তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবি মেহেদি হাসান টিবিএসকে বলেন, "জীবনযাত্রার ব্যয় এমনভাবে বেড়েছে যে এখন ঢাকায় টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। ৪ মাসের বেশি সময় ধরে ৫ সদস্যের পরিবার চালাতে প্রতিমাসেই ৬-৮ হাজার টাকা ধার করতে হচ্ছে। কিন্তু এ মাসে এই ধারের পরিমাণ ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি খরচের চাপে।"
বেড়েছে আটার দামও। পাইকারী বাজারে প্রতি কেজি আটার বস্তায় ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে ২১৮০ টাকায় উঠেছে। যার প্রভাব এখনো খুচরা বাজারে না পড়লেও দুই একদিনের মধ্যেই খুচরায়ও দাম বেড়ে যাবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
টিসিবি বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা আটার দাম ২-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৪২-৪৫ হয়েছে। শতাংশের হিসেবে এটা ৬.১০ শতাংশ। নতুন দামের আটা খুচরা পর্যায়ে আসলে এটা আরও বাড়বে।
এদিকে ঢাকার পাশাপাশি খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজারেও গত দুই দিনে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম মণে (৩৭.২ কেজি) ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ীর জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকে বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানিকারকরা। অথচ বিশ্ববাজারে গত তিন মাসে তা রেকর্ড পর্যায়ে কমে এসেছে। আমদানি মূল্য কম হওয়ার পরও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পরপরই পণ্যের দাম বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের বুকিং দর কম হলেও ডলারের বিপরীতে তাদের আগের চেয়ে অনেক টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর উপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বেড়ে গেছে পণ্য পরিবহন ভাড়াও।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আড়ত ও পাইকারি দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ঘোষণার পরদিন শনিবার থেকেই প্রায় সব পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ (৪০.৯০ লিটার) পাম অয়েলের দাম ছিল ৪৮০০ টাকা। দুই দিনে মণে ৩০০ টাকা বেড়ে সোমবার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৫১০০ টাকা।
একইভাবে মণে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সয়াবিন তেলের দামও। বাজারে প্রতিমণ সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৭০০০ টাকায়।
দুই দিনে মণে (৩৭.৩২ কেজি) প্রায় ১২০ টাকা বেড়েছে গম ও চিনির দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে ১৬২০ টাকা দামে। যা গত সপ্তাহের শেষে ১৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাজারে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হয়েছে ২৮৬০ টাকা দামে। যা সোমবার বিক্রি হয়েছে ২৯৬০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের ভোগপণ্য ব্যবসায়ী ও মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ বলেন, "বিশ্ববাজারে রেকর্ড পরিমাণে দাম কমে যাওয়ার প্রভাবে গেল এক-দেড় মাস দেশিয় বাজারেও কিছুটা কমে আসছিল ভোগ্যপণ্যের দাম। পাইকারি পর্যায়ে পাম অয়েলের দাম ৭০০০ টাকা থেকে কমে ৪৫০০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ভোগ্যপণ্যের বাজারকে আবারো উর্ধ্বমুখী করে তুলেছে।"
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এ জামান এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, "গত দুই মাসে বিশ্ববাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। যখনই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই দেশিয় বাজারে অস্থির হতে শুরু করে ডলারের দাম। কম দরে পণ্য বুকিং দিলেও তার মূল্য পরিশোধে ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।"
এর উপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে পণ্য পরিবহণ খরচ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে," যোগ করেন তিনি।
দাম কমছে বিশ্ববাজারে
আন্তর্জাতিক বাজারে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কমতে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ভোজ্যতেলের দাম। ধারাবাহিক দরপতনের পর সোমবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন পাম অয়েল ৯০২ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এর আগে ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর পর মার্চে পণ্যটির দাম উঠে সর্বোচ্চ ১৯৪৫ ডলারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে একইদিন প্রতিটন সয়াবিন তেল ১৪০৫ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে বেড়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতিটন সয়াবিনের দাম উঠে ১৭৬১ ডলারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর শুরুর দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন গম বিক্রি হয়েছে ৯১৬ ডলারে। একদিন পর টানা বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র দুই সপ্তাহেই অর্থাৎ ৭ মার্চ পণ্যটির বাজারদর ঠেকে ১৪২১ ডলার। তবে আস্তে আস্তে কমে সোমবার বিশ্ববাজারে প্রতিটন গম বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭৬৭ ডলারে।