সুন্দরবনের কুমির বারবার চলে আসছে লোকালয়ে

সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবন থেকে নোনা পানির কুমির বারবার চলে আসছে লোকালয়ে ।
কখনো মাছের ঘের, বাড়ির পুকুর, বা উপকূল-সংলগ্ন নদী-খালে তাদের দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও থেকে বন বিভাগ কুমিরগুলোকে উদ্ধার করে সুন্দরবনে পুনরায় অবমুক্ত করছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি বাগেরহাটের রামপাল রাজনগর ইউনিয়নের কালেখার গ্রাম থেকে একটি কুমির উদ্ধার করা হয়। এরপর ১১ মার্চ একই উপজেলার ভাগা গ্রাম থেকে আরেকটি কুমির উদ্ধার করা হয়। ২৯ মার্চ উপজেলার শ্রীরম্ভা এলাকার বাসিন্দা ইস্রাফিল গাজীর বাড়ির পুকুর থেকে জাল টেনে আরেকটি কুমির উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
এছাড়া গত ১২ এপ্রিল বাগেরহাটের মোংলায় বুড়িরডাঙ্গা এলাকায় চিংড়ি ঘের থেকে একটি কুমির উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়ের তেলগাতি গ্রামের ঘ্যাংরাইল নদীতে একটি কুমির অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'চলতি বছর আমরা লোকালয়ের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১০টি কুমির উদ্ধার করেছি। পরে ওই কুমিরগুলিকে গহিন সুন্দরবনে নিয়ে অবমুক্ত করা হয়েছে।'
সুন্দরবনে সর্বশেষ কুমিরের জরিপ করা হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। সেই জরিপে সুন্দরবনে লোনাপানি প্রজাতির প্রায় দুইশ কুমির রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
সুন্দরবনের ৪৫টি নদ-নদী ও খালসহ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার জলভাগের জন্য ২০০টি কুমির পর্যাপ্ত নয়। এই অবস্থায় কুমিরের সংখ্যা বাড়াতে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে প্রজনন করানো ১০০টি কুমির সুন্দরবনে অবমুক্ত করেছিল বন বিভাগ।
বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের সামনের নদীতে ৪০টি, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জে ২০টি করে কুমির অবমুক্ত করা হয়।
অবমুক্ত করা এসব কুমিরের বয়স দুই বছরের মতো, ওজন ৮ থেকে ১০ কেজি। নতুন করে তাদের বনে অবমুক্ত করার পর একাংশ লোকালয়ে আসতে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, 'প্রত্যেক বন্য প্রাণীর একটি এলাকায় রাজত্ব থাকে। সুন্দরবনে একটি একটি কুমির এক একটি এলাকায় রাজত্ব করে। সেখানে অন্য কুমির প্রবেশ করলে তাদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়।
'নতুন করে বনে কিছু কুমির অবমুক্ত করা হয়েছে। তারা নতুন এলাকা খুঁজে নিচ্ছে। কেউ কেউ বনে জায়গা করে নিয়েছে। কেউ কেউ অন্য কুমিরের সাথে ঝগড়া করে নতুন এলাকা খুঁজতে গিয়ে লোকালয়ে চলে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সুন্দরবনে নির্দিষ্ট এলাকায় রাজত্ব করার স্বভাব শুধু কুমিরের মধ্যে না; এটা বাঘের মধ্যেও আছে। এছাড়া বানরের মধ্যেও আছে।'
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, 'গত ৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা বাড়ছে। যার কারণে কিছু কুমির উপকূলীয় নদী-খালে চলে আসছে। অনেকসময় জেলেদের জালেও আটকা পড়ছে। আমরা খবর পেলে তাদের উদ্ধার করে বনে নিয়ে যাচ্ছি।'
বর্তমানে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার তেলগাতি এলাকায় ঘ্যাংরাইল নদীতে একটি কুমির অবস্থান করছে বলে নিশ্চিত হয়েছে বন বিভাগ।
ঘ্যাংরাইল নদীটি সুন্দরবন শিবসা নদীর উজানে অবস্থিত। এর আগে এই নদীতে প্রায় ৮০ বছর আগে কুমির দেখা গিয়েছিল।
ওই এলাকার ৭৪ বছর বয়সী কার্তিক জোয়ার্দার বলেন, 'আমার জন্মেরও আগে এই নদীতে কুমির ছিল। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে পাছু রাম হালদার নামের এক ব্যক্তিকে এই নদী থেকে কুমিরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর কখনো কুমির দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে একটি কুমির এসেছে।'
শোভনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত কুমার বৈদ্য বলেন, 'প্রায় একমাস ধরে ঘ্যাংরাইল নদীতে কুমিরটি অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে বন বিভাগের কর্মকর্তা এসে দেখে গেছেন।'
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা কার্যালয়ের মৎস্য বিশেষজ্ঞ মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে মিঠা পানির কুমির একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঘ্যাংরাইল নদীতে যে কুমিরটি এসেছে, সেটা সুন্দরবনের নোনা পানির কুমির। আমরা ওই এলাকার মানুষকে বলেছি, নদীতে কোনো খাবার না দিলে কুমিরটি চলে যাব। আর খাবার দিলে কুমিরটি থেকে যাবে, তখন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নদীতে থাকায় কুমিরটি ধরা সম্ভব হয়নি। ধরতে পারলে তাকে সুন্দরবনে নিয়ে অবমুক্ত করা হবে।'