শোকের গ্রাম খন্দকিয়া
শনিবার (৩০ জুলাই) সকাল থেকেই হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডি ইউনিয়নের খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। বিদ্যালয় মাঠে একে এক আনা হয় মিরসরাইতে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত রিদুয়ান চৌধুরী, জিয়াউল হক সজীব, ইকবাল হোসেন মারুফ, মোহাম্মদ হাসান ও গোলাম মোস্তফা নিরুর লাশ।
সকাল সোয়া দশটায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় বিদ্যালয় মাঠ। একসঙ্গে ৫ জনের জানাজা কখনো দেখেনি খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দারা। স্বজন হারিয়ে গ্রামবাসীরা শোকার্ত। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে জানা নেই!
বিদ্যালয় মাঠে রাখা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ছেলে মোহাম্মদ হাসানের লাশের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন আবুল কাশেম। স্বপ্ন ছিল এসএসসি পাশ করলে ছেলেকে দুবাই পাঠাবেন। সবজি বিক্রেতা বাবার সংসারের হাল ধরবে হাসান। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তব হলো না।
খন্দকিয়া এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ মুজিব বলেন, 'সড়কের অব্যবস্থাপনার কারণে এভাবে এতগুলো শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হলো। যতগুলো ছেলে মারা গিয়েছে, সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এখন এই পরিবারগুলোর হাল ধরবে কে? এই ঘটনার দায় কে নেবে?'
খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কাছাকাছি দূরত্বে দাফন হয় ইকবাল হোসেন মারুফ এবং জিয়াউল হক সজীবের। মারুফ এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং সজীব চট্টগ্রাম এমইএস কলেজের গণিত বিষয়ে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। যুগিরহাট বাজারে আরএন্ডজে প্রাইভেট কেয়ারের শিক্ষক ছিলেন সজীব।
একসাথে ৫ জনের জানাজার পর সকাল ১১টায় কে এস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুসহাব আহমেদ হিশামের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার রাতে সাজ্জাদ, রাকিব ও জিসানের জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়। এছাড়া নিহত অন্য দুজনের জানাজা নিজ নিজ এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কে এস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিউল আলম বলেন, 'দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের অনেকেই আমার বিদ্যালয়ের বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থী। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় এই এলাকা মেধাবী শিক্ষার্থীদের হারিয়েছে।'
দুর্ঘটনায় নিহতরা হাটহাজারী উপজেলার যুগীরহাট বাজারের শেখ মার্কেটের নিচতলার আরএন্ডজে প্রাইভেট কেয়ারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিলেন। শুক্রবার মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে রেললাইন পার হওয়ার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
শেখ মার্কেটের এস আলম ফোন সেন্টারে বসে নিহতদের স্মৃতিচারণ করে কাঁদছিলেন ওই এলাকার ষাটোর্ধ্ব মো. ইউনুছ। তিনি বলেন, 'নিহতরা আমরা পরিবারের কেউ না হলেও তাদের আচরণে মুগ্ধ ছিলাম। দুর্ঘটনার পর কিছুতেই তাদের স্মৃতি ভুলতে পারছি না। একসাথে এতগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীর চলে যাওয়া মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের।'
শেখ মার্কেটের ব্যবসায়ী তপন পাল বলেন, 'যে গাড়িতে করে শিক্ষার্থীরা পিকনিকে গিয়েছিল ওই গাড়ির চালক দক্ষ ছিল না। পেশাদার কোনো চালককে নিয়ে পিকনিকে গেলে হয়তো এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।'
সেনাবাহিনীতে চাকরির স্বপ্ন ছিল মারুফের
ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭) কে এস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্র্থী ছিল। তার বাবা আবদুল মাবুদ দুই ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে চলে যান অন্যত্র। ছোটবেলা থেকেই মা কামরুন নাহারের সঙ্গে নানার বাড়িতেই বড় হয়েছে মারুফ।
স্কুলে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসির) সদস্য হিসেবে একাধিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে মারুফ। সেই সুবাদে বাংলাদেশ সেনাবাহীনির সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।
আরএন্ডজে প্রাইভেট কেয়ারের সহপাঠীদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায় মারুফ। সেইসাথে সমাধি হয় তার স্বপ্নের।
কামরুন নাহার স্বপ্ন দেখতেন ছেলে বড় হয়ে তার সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে।
শনিবার (৩০ জুলাই) সকালে খন্দকিয়া গ্রামের আবদুল ওয়াদুদ মাস্টারের বাড়িতে গেলে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। মারুফের মা কামরুন নাহারকে ঘিরে আছে প্রতিবেশীরা। ছেলের শোকে তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন বারবার।
মারুফের নানি নুর নাহার বলেন, 'আমার মেয়ের স্বামী তার তিন সন্তানকে রেখে চলে যাওয়ার পর নানাবাড়িতেই বড় হয়েছে মারুফ ও তার দুই ভাইবোন। সন্তান বড় হলে সংসারের হাল ধরবে এমন আশায় বুক বেঁধেছিল আমার মেয়ে। কিন্তু এখন তার কী অবলম্বন হবে?'
ইকবাল হোসেন মারুফের বোন সয়েমা নাহার এবং ভাই শাহরুখ খান ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ভাইয়ের এমন চলে যাওয়ায় শোকে বিহ্ববল দুই ভাইবোন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার যুগিরহাটের আরএন্ডজে প্রাইভেট কেয়ারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে শুক্রবার মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যায়। ঝরনা দেখে ফেরার পথে বড়তাকিয়া এলাকায় রেললাইন পার হওয়ার সময় মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ যাত্রী নিহত হন।
দুর্ঘটনায় আহত হন ৬ জন। তারা হলেন তৌহিদ ইবনে শাওন (২০), তাসমির হাসান, মো. সৈকত, ইমন (১৯), তানভীর হাসান হৃদয় ও সাজ্জাদ (২৩)। আহতরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।