এবারেও ভোগান্তি নিয়ে সড়কপথে ঈদযাত্রা, লঞ্চে পাল্টেছে চিত্র
পবিত্র ঈদুল আজহার আগে শেষ কর্মদিবস ছিল বৃহস্পতিবার। রাজধানীর বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় দুপুরের পর থেকেই বাড়তে থাকে। অনেকেই আধাবেলা অফিস করে পরিবার নিয়ে টার্মিনালগুলোতে ভিড় করেছেন বাস, ট্রেন ও লঞ্চের জন্য। ফলে রাজধানীর গণপরিবহনেও দেখা যায় বাড়তি চাপ।
বেসরকারি চাকরিজীবী নুসরাত বেগম রংপুরের গ্রামের বাড়িতে যেতে দুপুরে অফিস শেষ করেই গাবতলী গিয়ে বাস খোঁজেন। আগে টিকেট কেটে না রাখায় গাবতলী গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরেও কোনো বাসের টিকিট না পেয়ে মাইক্রোবাসে ১২০০ টাকায় একটি সিট ম্যানেজ করেন।
নুসরাত বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তিনদিন আগে বাস কাউন্টারে এসেও কোনো বাসের টিকিট না পেয়ে ফিরে যাই। তাই বৃহস্পতিবার আগে গিয়েই লোকাল বাসে যেতে চাইলে ভাড়া একদিকে দেড় থেকে দুই গুণ চায়। তারপরেও বাস পেতে ৩/৪ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হবে বলায় প্রাইভেটকারে উঠেছি।"
শুধু নুসরাত বেগমই নয়, এমন চিত্র দেখা যায় রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, গুলিস্তানের বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে।
বাস কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা লোকজন বলছেন, ঈদের সময় প্রতি টিকেটে ১০০-১৫০ টাকা বেশি সবসময়ই নেওয়া হয়। তবে কোথাও কোথাও কাউন্টার থেকে তৃতীয় পক্ষ টিকিট নিয়ে বাইরে বাড়তি দামেও বিক্রি করতে দেখা যায়।
গাবতলী থেকে উত্তরবঙ্গগামী বাসগুলো পেতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা দেরি হয়েছে অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীদের। এর কারণ হিসেবে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটকে দুষছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
হানিফ পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার মোহাম্মদ জাহির টিবিএসকে বলেন, "এবারের ঈদে গাবতলী বাস টার্মিনালে যাত্রী সংখ্যা অনেক কম। কারণ পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন অনেকেই ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে সায়েদাবাদ দিয়েই চলাচল করছে। তবে উত্তরাঞ্চলের যাত্রীরা এদিক দিয়ে যাচ্ছেন।"
সিরাজগঞ্জ যাবেন কলেজছাত্রী সায়মা। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আপন মানুষদের কাছে যেতে না পারলে ঈদ পূর্ণতা পায় না। তাই ভোগান্তি-বিড়ম্বনাকে সঙ্গী করে ঈদে বাড়ি যাচ্ছি।"
দুপুরের পর থেকে মহাখালী বাস টার্মিনালে ভিড় বাড়তে থাকে যাত্রীদের। সিলেটগামী যাত্রীরা এসে দেখেন টিকিট সব শেষ হয়ে গেছে। ময়মনসিংহ, জামালপুরের যাত্রীরা অভিযোগ করে তাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া রাখা হচ্ছে।
যাত্রী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "সায়েদাবাদে প্রচুর ভিড় যাত্রীদের। এ সুযোগে ভাড়া বেশি নিচ্ছে বাসে। সায়েদাবাদ থেকে ঝিনাইদহ যেতে মামুন এন্টারপ্রাইজ পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে ১২০০ টাকা। এটা এক মাস আগেও ছিল ৫০০ টাকা।"
ঢাকা কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহম্মদ আলামিন। গ্রামের বাড়ি জামালপুর যাবেন। তিনি বলেন, "গত ঈদুল ফিতরে রাজিব পরিবহনে বাড়ি গিয়েছি ৪০০ টাকায়। কিন্তু এবার জামালপুর যেতে ভাড়া চাচ্ছে ৮০০ টাকা।"
রাজিব পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায় কাউন্টারে লোক বসে থাকলেও টিকিট দেয়া হচ্ছে না। যাত্রীদের ডেকে ডেকে সরাসরি গাড়িতে তুলছেন পরিবহনের লোক।
৮০০ টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠছিলেন মরিয়ম বেগম। তিনি বলেন, "আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছি। কিছু করার নেই।"
এ বিষয়ে মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হয় বিআরটিএ'র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমরা রাজিব পরিবহনের ম্যানেজারকে ডেকেছি। তারা কোনভাবেই ভাড়া বেশি রাখতে পারে না।"
রফিকুল ইসলাম একতা পরিবহনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাবেন, ভাড়া নিয়েছে ৮১৫ টাকা। তিনি বলেন, "গাড়ির শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে, ৩টার গাড়ি ৫টায়ও আসছে না।"
এনা পরিবহনের টিকেট মাস্টার মফিজুল ইসলাম বলেন, "সিলেটের টিকেট আমাদের শেষ হয়ে গেছে। আগামীদিনের টিকিটও নেই।"
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী যাত্রীদের দীর্ঘলাইন দেখা গেছে এনা পরিবহনের সামনে। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট পাচ্ছেন না। কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে জ্যামের কারণে রাস্তায় আটকে রয়েছে গাড়ি। তাই যাত্রীর তুলনায় গাড়ি সংকট তাদের।
টিকিট না পেয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ঈদযাত্রা
ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির দিনগুলোতে টিকিট পায়নি অনেক মানুষ। তাই অনেকেই ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনের ছাদে এবং ভিতরে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে কম্যুটার ট্রেনগুলোতে দেখা যায় এমন চিত্র। তবে আন্তঃনগর ট্রেনের ছাদে যাত্রী যাওয়ার তেমন চিত্র দেখা যায়নি।
ট্রেনের যাত্রীরা বলছেন, ঈদযাত্রায় সড়কে নানা দুর্ভোগ থাকায় কোনোভাবে হলেও যেতে চান ট্রেনে। তাছাড়া খরচও কম।
বৃহস্পতিবার বিকালে দেখা যায়, জামালপুর কম্যুটার ট্রেনের প্রত্যেকটা বগিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অন্যদিকে কয়েক হাজার মানুষ উঠে পড়েছে ট্রেনটির ছাদে।
জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে যেতে ট্রেনের ছাদে পরিবারসহ উঠেছেন সাইফ আহমেদ। তিনি টিবিএসকে বলেন, "দু'দিন দাঁড়িয়ে থেকেও ট্রেনের টিকিট পাইনি। এছাড়া বাসের ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি। সড়কপথে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে। তাই কষ্ট হলেও ট্রেনে যাই। ট্রেনের ভিতরে স্থান না পেয়ে ছাদে উঠলাম।"
ময়মনসিংহগামী যাত্রী ইলিয়াস টিবিএসকে বলেন, "উপায় না পেয়ে কাঁধের দুটি ব্যাগ নিয়েই ট্রেনের ছাদে উঠেছি। বাসে গেলে অনেক টাকা লাগে তাই কষ্ট হলেও ট্রেনে যাচ্ছি।"
এদিকে প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের টিকিট ছাড়া ঢোকার নিয়ম না থাকলেও অনেকে টিকিট ছাড়াই কম্যুটার ট্রেনগুলোতে উঠেন। যাত্রীর চাপের কারণে সবার টিকিট চেক করারও সুযোগ পাচ্ছেন না ট্রেনগুলোর টিকিট চেকাররা।
তবে ট্রেনগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে ছাদে ওঠায় অনেককেই নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় পুলিশ ও আনসার সদস্যদের।
সদরঘাটে নেই চিরচেনা সেই ভিড়
এবারের ঈদযাত্রায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে সদরঘাটে। আগের মতো সেই চিরচেনা ভিড় নেই ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের দিকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে। একদিকে নেই যাত্রীদের চাপ, অপরদিকে লঞ্চে বাড়তি ভাড়া নেওয়ারও নেই তেমন কোনো অভিযোগ।
বৃহস্পতিবার সদরঘাটের লঞ্চগুলো ঘুরে দেখা যায়, লঞ্চের টিকিট পেতে নেই দৌড়ঝাঁপ-ধাক্কাধাক্কি, নেই ডেকে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা, ফাঁকাও যাচ্ছে কেবিন। মানুষের ভিড়, টিকিট-কালোবাজারি এসব কিছুই দেখা যায়নি।
মূলত পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই বদলে গেছে লঞ্চঘাটের চিত্র। ফলে ফাঁকা কেবিন আর কম যাত্রী নিয়েই ঢাকা ছাড়ছে দক্ষিণের লঞ্চগুলো।
এদিকে লঞ্চভাড়াও স্বাভাবিক দেখা গেছে। অন্যবার ভাড়া ৫০-১০০ টাকা বেশি রাখলেও এবার ভাড়া আগের মতোই রাখা হচ্ছে। উল্টো ছোট লঞ্চে কেবিনের ভাড়া ১০০-৩০০ টাকা কম নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা থেকে রাত ৮-৯টায় লঞ্চে উঠলে ভোরেই ভোলায় পৌঁছানো যায়। তাই সেতুর প্রভাব পড়েনি এ রুটে। ভোলা জেলার সঙ্গে কোনো স্থলপথ সংযোগ না থাকায় এ পথে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতে যাত্রী স্বাভাবিক দেখা যায়।
যাত্রী মোহম্মদ রাহাত বলেন, "সকালে অফিসে যাওয়ার সময় গ্রামের বাড়ি বরিশাল যাবার উদ্দেশে তৈরি হয়ে গিয়েছি। অফিস শেষে লঞ্চে বাড়ি যাবো। গাড়িতে না যাওয়ার বিষয়ে বলেন, মুলাদিতে সরাসরি অল্প কয়েকটি বাস যায়। সেখানেও মিরগঞ্জের ফেরি পার হতে হয়। ঢাকা থেকে সরাসরি মুলাদির লঞ্চ আছে, সহজেই যাওয়া যায়।"
মানিক লঞ্চের ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, "এবার সদরঘাটে ঈদের আমেজ নেই। আগে ঈদের সময় দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে লঞ্চ গন্তব্যে যেত, আসত খালি। এতে পুষিয়ে যেত। এখন লঞ্চে স্বাভাবিক সময়ের মতো আমাদের যাত্রী টানতে হচ্ছে।"
ঢাকা নদীবন্দরের ঘাট পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, "আমার জীবনে বহু ঈদ দেখেছি। ঈদের আগের দিন গেটগুলো দিয়ে পন্টুনে আসা যাত্রীদের জায়গা দিতে পারতাম না। এবারে ঈদে তেমন কোনো পরিস্থিতি নেই। যাত্রী স্বাভাবিক সময়ের মতো।"
এদিকে ঈদ উদযাপনে রাজধানীবাসী যখন ঘরমুখো, সে সময়ে সুযোগ নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। বছরজুড়ে যেসব গাড়ি রাজধানীতে চলাচল করে, সেগুলো এখন যাত্রীবোঝাই করে চলে যাচ্ছে রাজধানীর বাইরে।