পদ্মাসেতুর আদলে দ্বিতল রেল কাম সড়কসেতু হবে কালুরঘাটে
কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট পয়েন্টে পদ্মা সেতুর আদলে নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের প্রাথমিক নকশা তৈরি করেছে কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, সেতুর ওপরে থাকবে দুই লেনের সড়ক এবং নিচে থাকবে দুই লেনের রেললাইন। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান কালুরঘাট সেতু থেকে ৭০ মিটার উজানে অর্থাৎ উত্তরে নতুন সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
সম্ভাব্য দাতা সংস্থা কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এক্সিম ব্যাংকের নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রাথমিক সমীক্ষা শেষে সেতু নির্মাণের স্থান, নকশা, ব্যয় ও নির্মাণকাল নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তাবনা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেছে।
বুধবার চট্টগ্রামের রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল হেড কোয়ার্টার সিআরবিতে ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে সেতু এলাকা অর্থাৎ চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ।
মোছলেম উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কালুরঘাটে নতুন সেতুটি পদ্মা সেতুর আদলে হবে। ব্রিজের ওপরের ডেকে থাকবে সড়ক, নিচের ডেকে থাকবে রেললাইন। কালুরঘাটে নতুন রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। আগামী আগস্টে তারা সরকারের কাছে ফাইনাল ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট জমা দেবে। এজন্য রেলের সাথে একটা ফাইনাল বৈঠক হয়েছে।'
ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছে কাজ শুরুর সময় থেকে চার বছর। আর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একনেকে অনুমোদন, দরপত্রসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা সেতুর কাজ শুরু করতে পারবে। সেক্ষেত্রে সেতুটি নির্মাণ শেষ হতে বর্তমান সময় থেকে পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে নতুন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের সর্বশেষ ফিজিবিলিটি স্টাডির পর, আমাদের যেটা জানানো হয়েছে সেটা হচ্ছে, সড়ক ও রেলপথ দুটোই ডাবল লাইন হবে। প্রাথমিকভাবে ব্রিজের দৈর্ঘ্য আমাদের বলা হয়েছে ৭৮০ মিটার এবং ভায়াডাক্ট ৫.৬২ মিটার। স্প্যান হবে ১০০ মিটার। ব্রিজের উচ্চতা হবে ১২.২ মিটার।'
'ফাইনাল ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট জমা দেবার পর টেন্ডার হবে। টেন্ডারের পর নির্মাণকাল প্রায় চার বছর আমাদের বলা হয়েছে। আমাদের টেন্ডার শেষ করতে প্রায় ছয় থেকে আট মাস সময় লাগবে। তারপর ইডিসিএফ ফান্ড দেবে। ফান্ড দিলে কাজ শুরু হবে। সেক্ষেত্রে টোটাল কস্ট আমাদের বলা হয়েছে ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকার মতো', বলেন জাহাঙ্গীর হোসেন।
প্রকল্প পরিচালক গোলাম মোস্তফা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নতুন বহুমখী কালুরঘাট সেতুটি হবে বর্তমান সেতু থেকে ৭০ মিটার উজানে হালদা নদীর মোহনার কাছাকাছি। নতুন সেতুর অ্যালাইনমেন্ট হবে জানে আলী হাট থেকে গোমদন্ডি রেল স্টেশন পর্যন্ত। এছাড়া সেতুর সাথে সংযোগ সড়কের কাজ করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।'
কালুরঘাট সেতু নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে দাবি করে মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, '২০১০ সালেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন কালুরঘাটে নতুন একটি সেতু নির্মাণ করে দেবেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে বিভিন্ন জটিলতার কারণে প্রকল্পটি একনেকে উঠেও ফেরত এসেছিল। মাঝে আবারও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল দুইটা ব্রিজ করার জন্য। একটা রেলব্রিজ, আরেকটা রোড ব্রিজ। পরবর্তীকালে তারা ওইটা ডিজাইন করে। যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেওয়া হল, তিনি বললেন আমি তো আলাদা সেতুর কথা বলিনি। একটাই ব্রিজ হবে, এতে রেলও থাকবে, রোডও থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের এক নম্বরে ছিল কালুরঘাট সেতু।'
'কোরিয়ান প্রকৌশলী সংস্থা ও রেলকে প্রস্তাব করেছি, দুইপাশে গাড়ি ওঠানামার জায়গা যেন মানুষের ব্যক্তিগত জায়গা বাঁচিয়ে করা যায়। মানুষের জায়গা নিতে গেলে ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা হয়। সেজন্য বাইরে থেকে যতদূর সম্ভব কম ভূমি অধিগ্রহণ করে রেলওয়ের জায়গা ব্যবহার করে সেতুটা করার জন্য একটা সুপারিশমালা আমরা দিয়েছি।'
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনা করার জন্য কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স নামে একটি সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী নদীতে প্রথম সেতুটি নির্মাণ করে। মূলত ট্রেন চলাচলের জন্য ৭০০ গজ লম্বা সেতুটি ১৯৩০ সালের ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। পরে ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচলের যোগ্য করে সেতুটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। জরাজীর্ণ সেতুটির বয়স এখন ৯২ বছর। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এছাড়া লক্করঝক্কর সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ঝুঁকি তো আছেই।