দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দিতেই ফিরল লোডশেডিং

বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধিতে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি রান্নার চুলাতেও কমেছে গ্যাসের সরবরাহ। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ে ভুগছেন সারাদেশের মানুষ।
সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। ফলে গ্যাস সরবরাহ গত কয়েক দিনে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে কমাতে হয়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। একইভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে এক স্ট্যাটাসে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, "গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।"
তিনি বলেন, যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের উচ্চমুল্য এবং সরবরাহ সব দেশকেই সমস্যায় ফেলেছে। বিষয়টি আমাদেরকেও বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ তেল–গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। দুই দিন ধরে দিনে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট করে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিছুদিন ধরেই ধাপে ধাপে কমানো হচ্ছিল সরবরাহ। এলএনজি কেনা না হলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই আপাতত। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৪০ ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে।
সরকারিভাবে এলএনজি আমদানি করে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)।
সরকারি এ কোম্পানির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত মাসে স্পট থেকে তিনটি কার্গো (জাহাজ) এসেছে। দিনে ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট করে সরবরাহ করা হয়েছে। এ মাসে কয়েক দিন ধরে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। মূলত, রোববার থেকে সরবরাহ এমন কমে যায়। এখন শুধু দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে আসা এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।
গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে শিল্প কারখানায়
গ্যাসের সংকটে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় রান্নার গ্যাসের সংকট যেমন হচ্ছে তেমনি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায়। সেই সঙ্গে কিছু কিছু এলাকায় শিল্পে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। এর মধ্যে কেবল গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় গ্যাসের চাপ কিছুটা ভালো।
গ্যাস সংকটের কারণে শিফট কমিয়ে ও ইউনিট বন্ধ করে সমন্বয় করছেন বলে দাবি করছেন তৈরি পোশাক, সিরামিকস, রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা।
গাজীপুরে স্থাপিত দেশের সিরামিক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান গ্রেটওয়াল সিরামিকসের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সিরামিকস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং গ্রেট ওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল হুদা বলেন, গ্যাসের চাপ ঠিকমতো না পাওয়ায় জুন মাসে ১৫ দিনের মতো কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। চলতি মাসে সংকট আরো বেড়েছে। তিন শিফটের কারখানা কোনো রকমে এক শিফটে চালু রাখছি।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, গত ৫-৬ দিন ধরে গ্যাস সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গাজীপুর ও ভালুকায় অবস্থিত দুটি কারখানায় গ্যাসের চাও দিনে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ২ পিএসআই পাওয়া যায়, যেখানে অনুমোদিত পিএসআই ১৫.৩১ কেভি লাইনের বিদ্যুৎও দিনে পাঁচ ঘন্টা থাকে না।
তিনি বলেন, এখন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা ও মান ঠিক রাখতে আলাদা করে ডিজেল ক্রয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচেছ, যাতে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা করে বাড়তি খরচ হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের এনজি ফেব্রিকস লিমিটেড, শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডসহ অন্তত পাঁচটি কারখানার তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে গ্যাসের চাপ শূন্য থেকে দুইয়ের মধ্যে ছি।
স্পিনিং মিল মালিকদের নিজস্ব একটি সামাজিক যোগাযোগের গ্রুপে তারা ইস্যুটি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে চলছেন।
একাধিক শিল্প মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকায় তাদের উদ্বেগ বাড়ছে এবং তারা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে রয়েছেন।
টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় নির্ধারণে গতরাতে সংগঠনটির নেতারা রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সভা করেছেন।
তারা ইস্যুটির দ্রুত সমাধান চেয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের খোরশেদ আলম।
ঢাকায় ৪-৫ ঘণ্টা লোডশেডিং
এদিকে গ্যাসের অভাবে কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। চাহিদা মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না বিতরণ কোম্পানি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে দিনে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আবার বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে জ্বালানি নির্ভর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও।
তাই সারা দেশে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দিনে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বারিধারা, কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জ, সাভারসহ বেশ কিছু এলাকায় সোমবার ৪-৫ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেখেছেন নাগরিকরা।
সোমবার ঢাকায় চাহিদার চেয়ে ৩০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। দিনে এ সংস্থার চাহিদা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, সরবরাহ পাচ্ছে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। রাজধানীর আরেকটি বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর সরবরাহ কমেছে দিনে ১৫০ মেগাওয়াট। এ সংস্থার দিনে চাহিদা ১ হাজার মেগাওয়াট, পাচ্ছে ৮৫০ মেগাওয়াট।
ডিপিডিসির ব্যবস্থপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান বলেন, গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন এলাকায় ভাগাভাগি করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। গতকাল থেকে এ পরিস্থিতি চলছে বলে জানান তিনি।
ঢাকার বাইরে সর্বত্র ভোগান্তি
উত্তরবঙ্গে শিল্প এলাকায় বগুড়ায় প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ৮২ মেগাওয়াট। কিন্তু সোমবার জেলাটিতে সরবরাহ করা হয়েছে ৪২ মেগাওয়াট।
বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা ও শ্যামলী হোটেলের পরিচালক তাহমিনা পারভীন শ্যামলী জানান, দিনে ১০ থেকে ১৫ বার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করছে। কখনো পাঁচ মিনিট কখনো ১ ঘণ্টা পর পর এমনটি চলছে। ফলে হোটেলের ফ্রিজ, এসি, টিভিসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য নষ্ট হওয়ার পথে।
বগুড়ার মতোই খারাপ পরিস্থিতি ঢাকার বাইরের সব জেলায়। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার সরবরাহ কমেছে ৮৫১ মেগাওয়াট।
তারা বলছেন, সারা দেশেই লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয়। এছাড়া রংপুর, ঠাকুরগাও, রাজশাহী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরে বেড়েছে লোডশেডিং। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বরিশালের পটুয়াখালী, ঝালকাঠিতে দিনে সাত থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ (পিডিপি) চট্টগ্রাম দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে গত পরশু থেকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। মূল গ্রিডলাইন থেকে সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎয়ের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের রাজশাহী কাটাখালী গ্রিড উপকেন্দ্রের ইনচার্জ হাবিবুর রহমান জানান, রাজশাহী মহানগর ও জেলা মিলে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ২০০ মেগাওয়াট। কিন্তু আমরা এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছি গড়ে ৯৫ থেকে ১৩০ মেগাওয়াট। এই কারণে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
সংবাদ তৈরিতে সহায়তা করছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষিপুর, সাতক্ষীরা, সিলেট ও সাভার প্রতিনিধি