৪৬% নিয়োগকর্তা চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী খুঁজে পান না: গবেষণা
দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ বেসরকারি নিয়োগকর্তারা চাকরির শূন্যপদ পূরণে প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থী খুঁজে পেতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
চাকরির শূন্যপদে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পেতে নিয়োগকর্তারা প্রধান যে দু'টি বাধার সম্মুখীন হন তা হল, কাজের অভিজ্ঞতা (৩৫ শতাংশ নিয়োগকর্তা) ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার (৩২ শতাংশ) অভাব।
শনিবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং জার্মানভিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেডরিখ-এবার্ট-স্টিফটাং (ইবিএস) এর বাংলাদেশস্থ কার্যালয়ের যৌথভাবে পরিচালিত, 'স্কিলস গ্যাপ অ্যান্ড ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: অ্যান এক্সপ্লোরেটরি অ্যানালাইসিস' শীর্ষক গবেষণায় এইসব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
চলতি বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে পরিচালিত জরিপের এই ফলাফলগুলো রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করার পাশাপাশি অনলাইনেও প্রচার করা হয়।
অর্থনীতির বিভিন্নখাতে নিয়োজিত মোট ১০০ জন নিয়োগকর্তার মধ্যে সর্বোচ্চ উত্তরদাতা মিলেছে উৎপাদন এবং তথ্য ও যোগাযোগ খাতে। এই খাত দু'টি থেকে যথাক্রমে ২২ শতাংশ ও ২৬ শতাংশ উত্তরদাতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যে ধরনের দক্ষতার চাহিদা রয়েছে, তা চিহ্নিত করার ও বোঝার চেষ্টা করা হয়।
নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তিতে, সিপিডি ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৫০০ জন শিক্ষার্থী ও সাম্প্রতিক স্নাতক উত্তীর্ণদের মূল্যায়নে একটি দক্ষতা মূল্যায়ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। স্নাতক উত্তীর্ণদের অনলাইন দক্ষতা মূল্যায়নের ফলাফলে দেখা যায়, গড়ে সর্বোচ্চ নম্বর উঠেছে 'ক্রিয়েটিভিটি' বা সৃজনশীলতায়; অন্যদিকে, সর্বনিম্ন গড় নম্বর উঠেছে 'যোগাযোগ, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা, সংখ্যাগত দক্ষতা ও গণিতিক যুক্তিতে'।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "বাজারের চাহিদা ও স্নাতকদের সরবরাহের (দক্ষতা) মধ্যে একটি ব্যবধান রয়েছে। পাস করা স্নাতকরা তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছে না।"
তিনি আরও বলেন, "আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদাও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে, আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই।"
"সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের স্নাতক উত্তীর্ণরা কি চাকরি পেতে প্রস্তুত?" জিজ্ঞেস করেন তিনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়োগকর্তারা প্রার্থী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিয়ে থাকেন; সেগুলো হল, সফট স্কিলস (৮৩ শতাংশ নিয়োগকর্তা), হার্ড স্কিলস (৬৫ শতাংশ) ও কাজের অভিজ্ঞতা (৫১ শতাংশ)।
নিয়োগকর্তাদের মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কিলগুলোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, সময় ব্যবস্থাপনা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, টিম ওয়ার্ক ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, নেটওয়ার্কিং এবং সৃজনশীলতা।
অন্যদিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হার্ড স্কিলগুলো হল, কম্পিউটার চালানোর দক্ষতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা, ব্যবসায়িক দক্ষতা, সংখ্যাগত ও গাণিতিক দক্ষতা, অপারেশনার স্কিলস, সাধারণ জ্ঞান ও সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা।
বিডিজবস ডট কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, "গবেষণায় উঠে এসেছে, নিয়োগকর্তারা যোগাযোগ ও ইংরেজি ভাষার দক্ষতাকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। তারা মনে করেন, যদি একজন স্নাতক ইংরেজিতে ভাল হয়, তবে তার অন্যান্য দক্ষতাও ভাল হবে। তবে বাস্তবতা এমন নয়।"
"আমি অবাক হই, কেনো তাদের (নিয়োগদাতাদের) প্রধান দক্ষতা হিসেবে ইংরেজি প্রয়োজন, যেহেতু আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলার ব্যবহার রয়েছে," তিনি আরও যোগ করেন।
২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল বৃদ্ধির পর থেকে দেশের স্নাতকরা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছে; এই প্রবণতাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে মনে করেন মাশরুর।
তিনি বলেন, "তাই বেশিরভাগ স্নাতক এখন নিজেদেরকে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছেন, প্রাইভেট সেক্টরের জন্য নয়।"
গবেষণায় আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার কথা উঠে এসেছে, যা নিয়োগকর্তারা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে পেতে চান; সেগুলো হল, যোগাযোগের দক্ষতা (৬১ শতাংশ), সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (৪৬ শতাংশ), এবং টিম ওয়ার্ক বা দলগত কাজ ও নেতৃত্বদানের দক্ষতা (৩৭ শতাংশ)।
উত্তরদাতা নিয়োগকর্তারাদের ৪০ শতাংশের মতে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে কর্মীদের নতুন দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন হতে পারে।
যাহোক, কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোত্তম আউটপুট পেতে যে বিষয়গুলো বাধা তৈরি করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, অনুপ্রেরণার অভাব (৫১ শতাংশ), প্রশিক্ষণের অভাব (৪৬ শতাংশ), দক্ষতার অভাব (৩৮ শতাংশ), নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষমতা (৩৫ শতাংশ), মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব (৩৩ শতাংশ) ও অনুপযুক্ত কাজের পরিবেশ (২৯ শতাংশ)।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, "যদিও গবেষণায় সফট স্কিলের চাহিদা বেশি পাওয়া গেছে, তবে আমি মনে করি হার্ড স্কিল এখন বড় একটি সমস্যা।"
তিনি বলেন, "আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতির মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করা দরকার। এবং এটি মাধ্যমিক স্তর থেকেই নিশ্চিত করতে হবে, তৃতীয় স্তরে গিয়ে নয়।"
তিনি আরও বলেন, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারে চাকরি পেতে ইংরেজি ভাষায় আর দক্ষতার প্রয়োজন হবে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, "আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা সেক্টরভিত্তিক শিক্ষা পায় না এবং সবাই সরকারি চাকরি করতে চায়।"
প্রধান অতিথি হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, "আমরা বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরিবর্তন আনতে চাই। কারিগরি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সরকার দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কাজ করছে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গবেষণায় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারসহ নিয়োগকর্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা হার্ড স্কিলসের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ সফট স্কিলসও গড়ে তুলতে পারে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শিরিন আক্তার এমপি ও সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সৈয়দ ইউসুফ সাদাত গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।