৩৭ বছরে ৭০ হাজার চারা রোপণ করেছেন শাহজাহান
মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি গ্রাম। বিভিন্ন ধরনের ফলজ এবং বনজ গাছে ভরপুর গ্রামের প্রতিটি রাস্তাঘাট ও বসত বাড়ির আঙ্গিনা। রয়েছে বাহারী রকমের ঔষধি গাছও।
৩৭ বছর ধরে এই গ্রামে নিজ খরচে এসব গাছের চারা রোপন করছেন শাহজাহান বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি; কৌড়ি গ্রামে যিনি 'বৃক্ষ প্রেমিক' নামে পরিচিত। তবে গ্রামের সহজ-সরল মানুষেরা তাকে "গাছ শাজাহান" হিসেবে ডাকেন। ৩৭ বছরে কৌড়ি গ্রামে কমপক্ষে ৭০ হাজার গাছের চারা রোপণ করেছেন তিনি।
১৯৭৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে প্রবাসে চলে যান শাহজাহান বিশ্বাস। সেখানে প্রায় ৫ বছর কাটান তিনি। এরপর চলে আসেন নিজ গ্রামে। বাড়ির উঠানে গড়ে তুলেন বিশাল নার্সারী। সেখান থেকে ফলজ, বনজ এবং ঔষধি গাছের চারা নিয়ে রোপণ করতে শুরু করেন গ্রামের রাস্তা-ঘাটের দু'পাশের পতিত জমিতে।
নিজ খরচে রাস্তা-ঘাটের পাশের জায়গাগুলো পরিস্কার করে গাছের রোপণ করেই থেমে যাননি তিনি। এরপর গ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, খেলার মাঠ, পুকুরের পাড় এবং বিভিন্ন মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায় গাছের চারা রোপণ করেন তিনি।
নিজ খরচে গাছের চারা রোপণ করলেও জমির মালিকই গাছের মালিক। তার রোপণ করা গাছের চারায় তিনি কোন ভাগ রাখেননি। নেই কোন অর্থলোভ। এভাবেই প্রায় ৩৭ বছর ধরে কৌড়ি গ্রামে পরিকল্পিতভাবে ফলজ, বনজ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে সময় পার করছেন চিরকুমার শাহজাহান বিশ্বাস।
এছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম ও হরিরামপুর উপজেলা পরিষদ কার্যালয় এলাকাতেও অসংখ্য গাছের চারা রোপণ করেছেন তিনি। সবুজের সমাহারবেষ্টিত কৌড়ি যেন এক পরিকল্পিত গ্রাম। শুধুমাত্র চারা রোপণ করাই নয়, নিয়মিত এর রক্ষনাবেক্ষণও করেন তিনি। এসব গাছের যত্ন নিতে বেশ কয়েক জন স্থায়ী শ্রমিকও রয়েছে তার।
শাহজাহানের এমন উদ্যোগের পর আশেপাশের কয়েক গ্রামের মানুষও ঝুঁকছে বৃক্ষ রোপনের দিকে। এসব ব্যক্তিদের গাছ লাগানোর বিষয়ে বিনামূল্যে পরামর্শ দেন শাহজাহান। জীবনের প্রথম ভাগ থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এভাবেই গ্রামের সাধারণ মানুষ ও গাছ নিয়ে বেঁচে রয়েছেন তিনি। এসব গাছের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে তার সংসার জীবন।
স্থানীয় সোনাকান্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা খাতুন বলেন, 'প্রাণ-প্রকৃতির জন্য বৃক্ষের বিকল্প কিছু নেই। পুরো কৌড়ি ও এর আশেপাশের গ্রামগুলো সবুজ-শ্যামলে ভরপুর। শাহজাহান বিশ্বাস এই সবুজের নায়ক। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি গ্রামের বিভিন্ন পথে প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে ফাঁকা জায়গা পেলেই গাছের চারা রোপণ করে যাচ্ছেন'।
এম.এ রউফ ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক দাউদ হোসেন বলেন, 'এলাকার পতিত জমিতে নিজ খরচে গাছের চারা রোপণ করেন শাহজাহান বিশ্বাস। অথচ ওই গাছ থেকে তিনি কোন লভ্যাংশ নেন না। গাছ বিক্রি করে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তনও ঘটছে। গ্রাম থেকে দূর হয়েছে দারিদ্রতা'।
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একজন করে শাহজাহান থাকলে এই দেশ আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এই বৃক্ষ প্রেমিক বলেন, 'উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর কর্মজীবনের ৫ বছর অতিবাহিত হয় সিংগাপুর এবং মালয়েশিয়ায়। সেখানকার গ্রামগুলো গাছগাছালিতে ভরপুর এবং অনেক সুন্দর। সেখান থেকেই মূলত গাছ রোপণের স্বপ্ন বুনি'।
এরপর নিজ গ্রামে এসে গাছের চারা রোপণ করা শুরু হয়। প্রথম দিকে গাছের চারাগুলো হাট বাজার থেকে কিনে এনে বুনন করলেও পরে নিজ বাড়ির উঠানের ১০০ শতাংশ জমিতে নার্সারী করা হয়। সেখান থেকে চারা নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় রোপণ করা হয়।
অর্থের সংস্থান সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার ভাই-বোনদের ছেলে-মেয়েরা সবাই আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তারা যে হাত খরচ দেন সেখান থেকেই গাছের চারা রোপণের টাকা হয়ে যায়। এছাড়া তার নিজের ঠিকাদারি ব্যবসা ও জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা রয়েছে। যে কারণে গাছের চারা রোপণের জন্য কখনো কোন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন পড়েনি তার।
নিজের কোন সংসার না থাকায় গাছের পেছনে ইচ্ছেমত সময় দিতে পারেন। একজন অসহায় ব্যক্তিকে পাঁচশো টাকা দিলে সাংসারিক প্রয়োজনে তা খরচ করে ফেলে। অথচ ঐ ৫০০ টাকা দিয়ে কয়েকটি গাছের চারা তার জমি বা বাড়ির উঠানে রোপণ করে দিলে কয়েক বছর পর তা লাখ টাকার সম্পদ হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাত ভাই-বোনের সংসারে বেড়ে উঠা শাহজাহান বৃক্ষ রোপণ সর্ম্পকে আরও বলেন, 'আজ থেকে প্রায় তিন যুগ আগে যখন গাছের চারা রোপণের জন্য রাস্তার পাশের জঙ্গল পরিষ্কার করতাম তখন এলাকার মানুষ নানা কথা বলতো। তবে এখন আর কেউ মন্দ কথা বলে না। সবাই অনেক সম্মান-শ্রদ্ধা করে'। গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে গ্রামের এই মানুষদেরকে নিয়েই বাকিটা সময় পার করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি।
ষাটোর্ধ্ব শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, বৃক্ষ রোপণের ফলে শুধুমাত্র গ্রামের সৌন্দর্যই বাড়ে না। এতে করে গ্রামের মানুষগুলো আর্থিকভাবেও লাভবান হয়। ৩৭ বছরে তিনি যে গাছের চারা রোপণ করেছেন তার আনুমানিক বর্তমান বাজারদর প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এই টাকার মালিক গ্রামের সাধারণ মানুষ।
মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বৃক্ষের কোন বিকল্প নেই। বৃক্ষ অমূল্য সম্পদ। আমাদের নিজেদের ভালো থাকার জন্য, সুখ-শান্তির জন্য এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য সকলকে গাছের চারা রোপণের আহ্বান জানান বৃক্ষ প্রেমিক শাহজাহান।