হাসপাতাল আছে, শুধু চিকিৎসা নেই

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি উদ্বোধনের বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে মিলে না স্বাস্থ্য সেবা। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও আসেনি। এমনকি চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় লোকবলও নিয়োগ করা হয়নি। ফলে আধুনিক অবকাঠামোর এই হাসপাতালটি অনেকটা অকেজো এবং অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে আলাদা হয়ে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে নবগঠিত বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ। ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষের বসবাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা দিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের চারটি কক্ষে বহির্বিভাগ চিকিৎসা সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালের ২৪ জুন ওই চার কক্ষে বহির্বিভাগ চিকিৎসা সেবার উদ্বোধন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।

দরপত্র প্রক্রিয়াসহ আনুষাঙ্গিক সকল কাজ সম্পন্ন করে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি চম্পকনগর এলাকায় তিন একর জায়গা নিয়ে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চারতলা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন ও চিকিৎসকদের জন্য কোয়ার্টার নির্মাণে ব্যয় হয় ২৫ কোটি টাকা। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন করেন।
আধুনিক অবকাঠামোর এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে শিশু, মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডসহ কেবিন এবং তিনটি অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে। কিন্তু এতসব থাকার পরেও শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে রোগীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা চালু করা যাচ্ছেনা। ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি শয্যা ও কিছু আসবাবপত্র এসেছে। কিন্তু চিকিৎসার যন্ত্রপাতি না আসায় সেগুলোও তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে স্টোর রুমে।

সরকারিভাবে লোকবল নিয়োগ না হওয়ায় হাসপাতালটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অস্থায়ীভাবে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রোগীদের টিকিট ফি’র টাকা থেকে তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আর সর্দি-কাশি ও জ্বর-চুলকানির মতো ছোট-খাটো রোগের চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে আটজন চিকিৎসক আনা হয়েছে। জেলার অন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ থেকে কিছু ওষুধ এনে রোগীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্স ভবনটি জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তুলনায় অনেক আধুনিক। এই হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে সংশ্লিষ্ট দফতরে চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় লোকবলসহ ৮২টি পদে জণবল নিয়োগের চাহিদাপত্র দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মধ্যে মাত্র ৪৬টি পদের অনুমোদন দেওয়া হয়। হাসপাতাল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর পাঠানো চিঠির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারী ৪৬টি পদের বেতনস্কেল নির্ধারণ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই ৪৬ পদের নিয়োগ প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। হাসপাতালটি উদ্বোধনের এক বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো যন্ত্রপাতিও দেয়া হয়নি। ফলে হাসপাতালের সবকটি ওয়ার্ড, কেবিন ও অস্ত্রোপচার কক্ষ তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্থায়ী ভিত্তিতে ওষুধ বিতরণের কাজ করা ইকবাল হোসেন জানান, আমরা অস্থায়ী ভিত্তিতে পাঁচজন কাজ করছি। এর মধ্যে আমি ওষুধ বিতরণ, আরেকজন টিকিট কাউন্টারে, দুইজন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং একজন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকেন। শুধুমাত্র ছোট-খাটো রোগের ওষুধ বিতরণ ছাড়া কিছুই হয়না এ হাসপাতালে। আমাদের বেতনও দুই-তিন মাস পরপর দেয়া হয়। সরকারিভাবে নিয়োগের আশায় আমরা অল্প বেতনে কাজ করছি।

তবে হাসপাতালটি সচল রাখতে সিভিল সার্জন ডা. শাহ আলম তার নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকদের দিয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন হাসপাতালে। তবে ছোট-খাটো রোগের সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না স্থানীয়রা।
হাবিবুর রহমান নামে চম্পকনগর গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এত বড় হাসপাতাল ভবন অথচ আমাদের চাহিদা মতো সেবা দিতে পারছেনা। চিকিৎসার জন্য আমাদের জেলা সদরেই যেতে হচ্ছে। তাহলে এ হাসপাতাল দিয়ে লাভ কী? সর্দি-কাশির মতো রোগের ওষুধ দেয়ার জন্য তো আর হাসপাতাল হয়নি।’’
মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা হামিদ মিয়া জানান, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার এক বছর পার হলেও হাসপাতালে কিছুই আসেনি। আমাদের এখনও শহরের হাসপাতালে গিয়েই চিকিৎসা নিতে হয়। সবার তো আর শহরে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। তাই দ্রুত হাসপাতালটিতে চিকিৎসকসহ সকল যন্ত্রপাতি দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. হামিদা মোস্তফা জানান, আমার পোস্টিং চম্পকনগর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। যেহেতু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক নিয়োগ হয়নি তাই আমিসহ অন্যদের এখানে রোগীদের সেবা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র জ্বর-কাশির মতো ছোট-খাটো রোগের চিকিৎসাই আমরা দিচ্ছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন ডা. শাহ আলম বলেন, বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি একটি আধুনিক স্থাপনা। কিন্তু সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় জনবল পদায়ন না হওয়া এবং যন্ত্রপাতির অভাবে রোগীদের কািঙ্খিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট দফতরে একাধিকবার চিঠি চালাচালি করেছি। আশা করছি অচিরেই এসব সমস্যা সমাধান করে রোগীদের পূর্ণাঙ্গ সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।