সুন্দরবনে পানি সংকটে পড়েছে বন্যপ্রাণীরা
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পশ্চিম সুন্দরবনের ভেতর ৫৩টি মিঠা পানির পুকুর ভেসে গেছে। এই পুকুরগুলোর পানি খেয়েই বেঁচে থাকে হরিণ, বাঘ, বানর, শূকরসহ সব ধরণের বন্যপ্রাণী। এত বিরাট সংখ্যক মিঠা পানির পুকুর ভেসে যাওয়ায় তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে সুন্দরবনে। ফলে বন্যপ্রাণি বাঁচাতে এসব পুকুর থেকে লোনা পানি নিস্কাশনের জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে বন বিভাগ।
বন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫৩টি সুপেয় জলের পুকুরের বাইরে সুন্দরবনের ভিতরের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার উপর। সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্চের বন ও বন্যপ্রাণির ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য কাজও শুরু হয়েছে।
শনিবার (২৯ মে) সকাল ১০টায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম সুন্দরবনে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্চের বুড়িগোয়ালীনি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তিন দিন সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তদন্ত টিমকে।
ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক সংখ্যায় বণ্যপ্রাণী এবার প্রাণহানির শিকার হয়নি। একটি মৃত হরিণ ভেসে আসার খবর পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত।
পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মো. মোহসীন হোসেন জানান, ঝড়ে পশুপাখির প্রাণহানি ঘটেনি, তবে বন্য শূকরের ক্ষতি হবার আশংকা তৈরি হয়েছে। আর বনের পশুপাখি খাবার পানির সংকটে পড়েছে।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্চের বুড়িগোয়ালীনি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদ জানান, বৈরী আবহাওয়া থাকায় গত তিনদিন সুন্দরবনের ভিতরে কাউকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর শনিবার সকালে তিন সদস্যের একটি দলকে সুন্দরবনে পাঠানো হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত বনের ভেতরে কোন বন্যপ্রাণি মারা গেছে খবর পাইনি।
বুড়িগোয়ালীনি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদ বলেন, জলোচ্ছ্বাসের কারণে মিঠাপানির পুকুরগুলো ভেসে গেছে। লবণাক্ত পানি ঢুকে গেছে পুকুরগুলোতে। বনের বাঘ, হরিণ, বানর, শূকরসহ সব ধরণের প্রাণি এই মিঠা পানির পুকুরগুলো থেকেই পানি পান করে বেঁচে থাকে। এমনিতে সুন্দরবনের নদী ও খালের পানি লবণাক্ত। পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণির জীবনে হুমকির মুখে পড়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা মিষ্টি পানির পুকুর থেকে লোনা পানি দ্রুত নিস্কাশনের ব্যবস্থা করব। তবে নিস্কাশনের পরও বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৃষ্টি আসলে পুকুরগুলো ভরে যাবে তখন বন্যপ্রাণিরা পানি মিষ্টি খেতে পারবে। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হলে কি করবেন এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি এই বন কর্মকর্তা।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের বাসিন্দা বনজীবী শহিদুল ইসলাম জানান, বনের ভিতরে কোন বন্যপ্রাণির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে পূর্ব বন বিভাগে হরিণের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাছাড়া উপকূলবর্তী নদীতে যারা ট্রলার চালান নদীতে সার্বক্ষণিক থাকেন তারাও পশুপাখির মৃত্যুর কোন খবর বলেনি।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পশ্চিম সুন্দরবন (খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ) ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেছে বিভাগীয় বন কার্যালয়। আর এ কার্যালয় থেকেই নিশ্চিত করা হচ্ছে, পশ্চিম সুন্দরবনে বন কর্মকর্তা ও বন্যপ্রাণিদের ৫৪টি মিঠা পানির পুকুরের মধ্যে ৫৩টি পুকুর ভেসে গেছে। এসব পুকুরে লবণপানি ঢুকে পড়েছে। কাজেই সুপেয় পানি নেই ওই অঞ্চলে।
এর বাইরে বনবিভাগ ক্ষয়ক্ষতির আরও যে তালিকা দিচ্ছে, তার মধ্যে জেটি ভেঙে গেছে ১২টি। খুলনার কয়রা ও বজবজা সুন্দরবনের টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৩৫টি ক্যাম্প ও স্টেশনের রাস্তা তছনছ হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। সুন্দরবনের মধ্যে আড়পাঙ্গাসিয়া ও রায়মঙ্গল নদীর বিভিন্নস্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বনবিভাগের টাকার হিসেবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মো. মোহসীন হোসেন বলেন, বর্তমানে শূকর প্রজনন মৌসুম, পানির অভাবে আশংকা করছি শূকরের বংশবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শূকরগুলোর জীবনই এতে হুমকিতে রয়েছে। বনে পানি ঢুকে পড়ায় বাচ্চাদের নিয়ে মা শূকরগুলো বিপদের মধ্যে রয়েছে। বনের ভিতরের মিঠা পানির পুকুরগুলো ডুবে যাওয়ায় বন কর্মকর্তা, বনজীবী ও বন্যপ্রাণিরা বিপদে পড়েছে। পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণিদের প্রজনন তারা নিজস্ব প্রাকৃতিক উপায়েই করে থাকে। প্রয়োজনে তারা প্রতিদিন পানি খায় আবার একদিন পর পরও খেয়ে থাকে। উপায় না পেলে প্রয়োজনে নদীর লোনা পানিও খেয়ে থাকে কোনো কোনো সময়। পুকুর ডুবে যাওয়ার বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো থেকে লোনা পানি নিষ্কাশন করতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। এছাড়া বর্তমানে সুন্দরবন থেকে জলোচ্ছ্বাসের পানি নেমে গেছে। তদন্ত টিম কাজ করছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সুন্দরবন পশ্চিম রেঞ্চে বন্যপ্রাণির আরও কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা সেটি জানা যাবে।
উল্লেখ্য, গত ২৬ মে বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা উপকূলে। এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। তছনছ হয়ে গেছে সাতক্ষীরার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ।