সিডরের ১৪ বছর: দুঃসহ স্মৃতির সেদিন
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত হানে বাংলাদেশের উপকূলে। ঝড়টি ভূমিতে আছড়ে পড়ার সময় প্রথম এক মিনিটে বাতাসের বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতিঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার, যা একে সাফির-সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি-৫ এর সাইক্লোনে পরিণত করে।
সাফির-সিম্পসন স্কেল বাতাসের তীব্রতার ভিত্তিতে ঘুর্ণিঝড় এর শক্তি নির্ণয় করে। এতে সর্বনিম্ন ক্যাটাগরি-১ থেকে সর্বোচ্চ হলো ক্যাটাগরি-৫ পর্যন্ত।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) সূত্র বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন সম্পদ ও জীবনের প্রতি অন্যতম বড় হুমকি। এমনকি সৃষ্টি হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়েও ব্যাপক ধবংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন হয়। জীবন ও সম্পদের ক্ষতিসাধনে এগুলোর প্রভাবও বহুমুখী, যেমন- জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, প্রচণ্ড ঝড়ো বায়ুপ্রবাহ এবং বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ সৃষ্টি করে প্রভাবিত অঞ্চলে। আবার সবগুলো প্রভাব একসঙ্গে মিলেও ধবংসলীলা চালিয়ে যেতে পারে বিস্তৃত এলাকায়।
ডব্লিউএমও জানায়, গত ৫০ বছরে এক হাজার ৯৪২টি দুর্যোগ সৃষ্টি করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন। যাতে মোট ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৩২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। বিনষ্ট হয় এক হাজার ৪০৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ। অর্থাৎ, প্রতিটি ঝড়ে গড়ে ৪৩টি মৃত্যু ও ৭৮ মিলিয়ন ডলার সম্পদহানি ঘটেছে।
তবে এসবই আনুষ্ঠানিক হিসাব, যেখানে একটি দুর্যোগ পরবর্তী পরিবেশগত প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। জীবিকার ওপর যে ব্যাপক ধবংসাত্মক চিহ্ন রেখে যায় ট্রপিক্যাল সাইক্লোন তাও সুদুরপ্রসারী।
সিডরের দিন বাংলাদেশ দুর্যোগের চরম রুপই দেখেছিল। ঝড় আঘাত হানার আগেই উপকূলীয় জেলাগুলোয় হয় প্রবল বর্ষণ। এরপর জলোচ্ছ্বাস বেশিরভাগ জায়গায় তিন মিটার বা ৯ দশমিক আট ফুট উচ্চতা নিয়ে আঘাত হানে। দ্য ওয়েদার নেটওয়ার্কের মতে, এসময় পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলায় পাঁচ মিটার বা ১৬ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসও আঘাত হানে।
সরকারি তথ্য অনুসারে ১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা শ্রীলঙ্কার দেওয়া নাম অনুসারে সিডরের নামটি ঠিক করে, যার অর্থ চোখ।
ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান:
উপকুলে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ এ দুর্যোগে ব্যাপক ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সম্পদ মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায় যেন। দুর্যোগের সময় সাগরে থাকা ৫০০ মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারের ৩ হাজার জেলে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান বলে উল্লেখ করেছে দ্য ওয়েদার নেটওয়ার্ক। স্থানীয় কৃষি খাত প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিপুল পরিমাণ ধানী জমির ফসল সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। দুর্যোগ পরবর্তীকালে মোট ক্ষতি ২১০ কোটি ডলার হিসাব করা হয়েছিল।
সেই সময় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানির কথা বলেছিলেন রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশের প্রধান। তবে সরকারিভাবে ছয় হাজারের মতো প্রাণহানির কথা বলা হয়েছিল। প্রকৃত সংখ্যা বেশি হওয়ারই অনুমান অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থার। দ্য ওয়েদার নেটওয়ার্কের বলছে কিছু হিসাবে সিডরে প্রাণহানি ১৫ হাজার পর্যন্ত হওয়ার অনুমান রয়েছে।
সিডরের ঝড়ো বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে নেমে আসে প্রলয়কাণ্ড। বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠিসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলায় ধব্বংসের ছাপ রেখে যায় সিডর।
প্রভাবিত হয় রাজধানী ঢাকাও। রাজধানীসহ সাড়া দেশেই হয় প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত। ঝড়ো বাতাসে উপড়ে পড়ে গাছপালা ও বৈদ্যুতিক লাইনের খুঁটি। দেখা দেয় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা। বিদ্যুৎ সংকটে দেশের অনেক এলাকায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ব্যাহত হয়।
সরকারি হিসাবে বাগেরহাট ও বরগুনাকে সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বাগেরহাটে ৯০৮ জনের মৃত্যু ও ১১ হাজার ৪২৮ জন আহত হওয়ার কথা জানায় সরকার। অপরদিকে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জনের মৃত্যু ও ১৫৬ জন নিখোঁজ থাকার কথা জানানো হয়।
দুর্যোগ পরবর্তী কালে উপকুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে দেখা দেয় সুপেয় পানির সংকট। মিঠা পানির উৎসগুলো লোনা পানিতে প্লাবিত হয়, দেখা দেয় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন উদরাময় রোগের প্রাদুর্ভাব। জায়গা সংকটে সিডরে মৃতদের অনেককেই গণকবর দিতে হয়েছে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোনে প্রায় পাঁচ লাখ মৃত্যুর কথা সরকারিভাবে বলা হলেও, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলোর অনুমান এতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০০ কিলোমিটার বেগের বাতাস ১০ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূল তছনছ করে দেয় এ ঘূর্ণিঝড়। দুর্যোগ মোকাবিলায় পাকিস্তান সরকারের অবহেলা ও পরবর্তীতে অপর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতাও জন-অসন্তোষ সৃষ্টি করে। যা বড় ভূমিকা রাখে আমাদের মুক্তির সংগ্রামে।
বিশ্ব গণমাধ্যম দুর্যোগ মোকাবিলায় পাকিস্তান সরকারের অবহেলার দিকটিও তুলে ধরে।
২০১১ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থে ভৌগলিক উন্নয়ন বিশারদ মার্ক পেলিং লিখেছেন, একটি দুর্যোগ কীভাবে প্রধান রাজনৈতিক কাঠামো বদলে দিতে পারে, ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সিডরের দুঃসহ স্মৃতি:
সিডরের স্মৃতি আজো ভোলেননি ভুক্তভোগীরা। শরণখোলার বাসিন্দা মিজানুর রহমান তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদলু এজেন্সিকে জানান, সিডর যখন আঘাত হানে তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন করছিলেন। স্বপ্ন ছিল চাকরি নিয়ে পিতামাতার কষ্ট ঘোচাবেন। কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি সিডর।
তিনি বলেন, "এই ঝড় আমার বাবা-মাকে কেড়ে নিয়েছে। আমি কোনোদিনই সে স্মৃতি ভুলতে পারব না।"
সিডরের সময় মিজানুরের বাবা আদম আলি খান ও মা আনোয়ারা বেগমের মতো লাখো উপকুলবাসী আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থেকে সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। যাদের অনেককেই পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মিজানুর ভাগ্যবান তিনি পরে হলেও কিছু দূরে তার পিতামাতার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিলেন। জলোচ্ছ্বাস তাদের দুজনকেই ভাসিয়ে নিয়েছিল।
বরগুনা জেলার বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, সিডরের আগে দীর্ঘদিন কোনো বড় ঝড় না আসায় উপকূলের অনেক মানুষ কর্তৃপক্ষের সতর্কবাণীতে গুরুত্ব দেননি।
তিনি আনাদলু এজেন্সিকে বলেন, "এর আগে সরকারের তরফ থেকে বেশ কয়েকবার জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের বিপদসংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু, তারপর বড় কোনো দুর্যোগ না হওয়ায় মানুষ সিডরের সতর্কবাণীও গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে, নিজ বাড়িতেই ছিলেন।"
তিনি জানান, এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি ও মৎসজীবি দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাই তারা বাড়িঘর, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি রক্ষা করতে বাড়িতেই রয়ে যান।
তবে সিডরের পর বেড়েছে উপকূলে দুর্যোগ সচেতনতা। স্বচ্ছল অনেক মানুষই দুর্যোগ সহযোগী পাকা দালান তৈরি করেছেন।
এখন বিপদসংকেত দেওয়া হলে, মানুষ কংক্রিটের দালানসহ সরকার নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে দ্বিধা করে না বলেও জানান তিনি।
সরকারের সচেতনতা কর্মসূচি:
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত-সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, এনডিআরসিসি ) শাহ মোহাম্মদ নাছিম আনাদলুকে জানান, সরকার এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বৃদ্ধিতে গণ-সচেতনতা তৈরির অনেক কর্মসূচি নিয়েছে।
তিনি বলেন, এজন্য দুর্যোগঘন এলাকায় ঝুঁকি প্রশমন ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয়দের সাথে বৈঠক, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। এসবের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পদ ও জীবনহানিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।
- তথ্যসূত্র: ডব্লিউএমও, দ্য ওয়েদার নেটওয়ার্ক, আনাদলু এজেন্সি