সালথায় সহিংসতা: গ্রেপ্তারের ভয়ে ৫০ গ্রাম পুরুষ শূন্য
ফরিদপুরের সালথায় লকডাউন না মানাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর জোরদার পুলিশি অভিযানের কারণে উপজেলার আশেপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে।
আজ শুক্রবার (৯ এপ্রিল) সকালে ওই সব এলাকার বাড়ি-ঘর গুলোতে নারী আর শিশু ছাড়া কোন সদস্য দেখতে পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে বিভিন্ন গ্রাম। বিশেষ করে উপজেলা সদর অবস্থিত রামকান্তপুর ইউনিয়ন, সোনাপুর ইউনিয়ন, গট্রি ও ভাওয়াল ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, সালথা উপজেলায় ১৬৫টি কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের জেলা শাখার আমীর ও সেক্রেটারীর বাড়ি এই সালথাতে। ওই রাতে হেফাজতে ইসলামের আমীর ও বাহিরদিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আকরাম আলীকে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা উস্কে দেয়া হয়েছে। এখন এসব এলাকার আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের মাঝেও উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাজ করছে।
রামকান্তপুর ইউনিয়নের শৌলডুবি গ্রামের মো. ইউনুস শেখের স্ত্রী মালেকা বেগম (৫২) বলেন, আমার স্বামী গ্রামে ক্ষেতে কাজ করেন। তিনিও বাড়িতে থাকার সাহস পাননা। যুবক ছেলেকে আগেই বাইরে আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা গ্রামের এক কলেজ ছাত্র বলেন, ঘটনার পর তিনি ফরিদপুর শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। ঘটনার সাথে জড়িত না হলেও অভিভাবকেরা তাকে গ্রামে রাখার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না।
ফুকরা বাজার এলাকার করিমন বেগম জানান, সব সময় ভয়ে রয়েছি। পুলিশ দেখতে দেখতে সারাদিন কেটে যাচ্ছে। বাড়িতে কোন পুরুষ সদস্য নেই। সবাই পালিয়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।
নূরজাহান নামে একজন জানান, ওই দিন অন্য এলাকা থেকে লোকজন এসে হামলা করছে। আমাদের গ্রামের কোন লোক ছিলো না। তিনি বলেন, শুনেছি ফুকরা বাজারে এসিল্যান্ডের সাথে থাকা সদস্যদের সাথে বাজারের লোকজনের গণ্ডগোলকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে।
ঘট্রি এলাকার মনির নামে একজন জানান, বালিয়া গট্রি এলাকা ও উপজেলা কেন্দ্রীক এলাকার বাড়ি গুলোতে কোন পুরুস সদস্য নেই। ঘটনার পর থেকে ওই সব এলাকার লোকজন পলাতক অবস্থায় রয়েছে বলেও তিনি জানান। তবে তিনি আশা করেন কোন নিরীহ লোক যেন হয়রানির শিকার না হন।
গত ৫ তারিখের ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৫টি। এই সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ২৬১ জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত ১৬ হাজার ৮০০ জনকে। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত আটক করা হয়েছে মোট ৫১জনকে। এ মামলায় রিমান্ডে রয়েছে ২৬ জন।
নতুন যে চারটি মামলা হয়েছে তার একটি করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মাতুব্বর। এ মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত আরও ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আরেকটি মামলা করেছেন সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা মোহাম্মাদ হাসিব সরকারের গাড়িচালক মো. হাশমত আলী। এই মামলায় ৫৮ জনের নাম উল্লেখ এবং ৩ থেকে ৪ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
অপর মামলাটি করেছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী সমীর বিশ্বাস। এ মামলায় ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং ৩ থেকে ৪ হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
আরেকটি মামলাটি করেছেন উপজেলা সহকারী কমিশনারের(ভূমি) গাড়িচালক মো. সাগর সিকদার। এ মামলায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে তিন থেকে চার হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
এর আগে বুধবার সালথা থানার এস আই (উপ পরিদর্শক) মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ৮৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং প্রায় চার হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে থানায় হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রথম মামলাটি করেন।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আলিমুজ্জামান বলেন, এ ঘটনার পর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মামলার আসামীদের ধরতে পুলিশ দিনরাত জোরদার অভিযান চালানো হচ্ছে। কারা কারা এর পিছনে কাজ করেছে সেসব আমরা সনাক্ত করতে পেরেছি। এজাহারে সেসব উল্লেখ রয়েছে। আরো বিস্তারিত জানতে তদন্ত চলছে।
তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা পুলিশ গ্রহণ করবে। এই ব্যাপারে কোন রকমের ছাড় দেয়া হবে না। এরই মধ্যে ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এই ঘটনায় গুলিবৃদ্ধ দুই জনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য লকডাউন না মানাকে কেন্দ্র করে সোমবার বিকালে সালথার ফুকরা বাজারে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এসিল্যান্ডের সাথে থাকা সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের। এর পরই বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ সালথা উপজেলা পরিষদ, এসি ল্যান্ড অফিস ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটায়।
অপরদিকে শুক্রবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্থ সরকারি স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ খলিলুর রহমান। তিনি সালথা উপজেলা পরিষদের ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন দপ্তর, ভূমি অফিস, চেয়ারম্যানের বাসভবন, ইউএনওর বাসভবন, সালথা থানা ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। তিনি এসময় বলেন, কোন বক্তব্য নয়, সরাসরি এ্যাকশনে যেতে চাই।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার, পুলিশ সুপার মোঃ আলিমুজ্জামান বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসিব সরকার, সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মোঃ সুমিনুর রহমান, সালথা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ওয়াদুদ মাতুব্বার, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ দেলোয়ার হোসেন, সালথা থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আসিকুজ্জামান প্রমূখ।