সাঙ্গু’র পাহাড়ী অংশে দেশের নতুন মাছ
দেশে মাছের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন আরও একটি প্রজাতি। সাঙ্গু নদীর প্রায় ২০০ কিলোমিটার উজানে বান্দরবানের তিন্দু-রেমাক্রি অঞ্চলে নতুন প্রজাতির মাছের সন্ধান পেয়েছেন চট্টগ্রামের একদল গবেষক। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে গবেষণা চালিয়ে মাছের এই নতুন প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে 'বাংলাদেশ বায়োডাইভার্সিটি রিসোর্স অ্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট' জার্নালে (জার্নাল অফ বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন অ্যান্ড বায়োরিসোর্স ম্যানেজমেন্ট)।
সাইকসম্যাটরিনকস নোকটা (Schismatorynchos nukta) বা শিংওয়ালা কার্প নামের এই মাছটি শনাক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী ও সুনামগঞ্জ কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম। মাছটি আইইউসিএন রেডলিস্টে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০১৫ সালের শীত মৌসুমে বান্দরবানের তিন্দু-রেমাক্রি অঞ্চলে এ প্রজাতির মাছের প্রথম সন্ধান পাই। জেলেদের বেড় জালে মাছটি ধরা পড়েছিল। পরের তিন বছর ধাপে ধাপে গবেষণা করে আমরা এটির পরিচয় শনাক্ত করেছি; গবেষণা এখনো চলছে।"
"বাংলাদেশে এই মাছের উপস্থিতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে ভারত মাছটিকে কেবল তাদের দেশেই পাওয়া যায় বলে ঘোষণা করেছিল। তবে, আমরা এখন এটিকে বাংলাদেশের বলেও দাবি করতে পারবো," অধ্যাপক আলী আজাদী আরও বলেন।
১৮৩৯ সালে মৎস গবেষক সাইকিস সর্বপ্রথম সাইকসম্যাটরিনকস নোকটা-কে 'সাইপ্রিনাম নোকটা' নামে বর্ণনা করেন। ফ্রান্সিস ডে ১৮৭৮ ও ১৮৮৯ সালে তার বিখ্যাত 'ফিশেজ অব ইন্ডিয়া' ও 'ফওনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে মাছটিকে দক্ষিণ ভারতীয় নদীসমূহের বলে উল্লেখ করেন। বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ও দক্ষিণ ওয়েস্টার্ন ঘাটের উচ্চভূমিতে কৃষ্ণা নদীর উজানে এবং উত্তরপূর্ব ভারতের আসাম, অরুনাচল ও ত্রিপুরায় এ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। নেপালের একটি বাণিজ্যিক সংস্থা এটিকে নেপালের মাছের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম বলেন, "শিংওয়ালা কার্প মাছটি দেখতে অনেকটা দেশি রুই ও মৃগেলের মাঝামাঝি গড়নের। মাছটির মাথার গঠন দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় এটি একটি অনন্য প্রজাতি। বাংলাদেশের অন্য কোথাও এই প্রজাতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।"
"বাংলাদেশের নদীতে মাছটির উপস্থিতি এর বৈশ্বিক বিস্তার ও এন্ডেমিক স্ট্যাটাসে পরিবর্তন আনবে। এখন পর্যন্ত সাইকসম্যাটরিনকস নোকটার চারটি জাত সম্পর্কে পৃথিবী জানতে পেরেছে। মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও সর্বশেষ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও মাছটি শনাক্ত হয়নি," অধ্যাপক আরশাদ আরও বলেন।
গবেষকরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, সাঙ্গু নদীর মাছের প্রজাতি বৈচিত্র গবেষণার জন্য ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত নদীর ভাটি থেকে প্রায় ২০০ কিমি উজানে, সরেজমিনে পরিদর্শন করে মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত মাছের নমুনায় বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু-রেমাক্রি অঞ্চল থেকে পাহাড়ি আবাসের বেশ কয়েকটি মাছের সঙ্গে অদ্ভুদ অবয়বের কিছু শিংওয়ালা কার্প মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকায় সাইকসম্যাটরিনকস ভুক্ত কোনো মাছ শনাক্তের ঘটনা ২০১৫ সালেই প্রথম।
ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম বলেন, "বান্দরবান শহর থেকে নদী পথে প্রায় ১১০ কিলোমিটার উজানে নদীর পাথুরে তলদেশযুক্ত অংশে মাছটি পাওয়া যায়। নদীর পার্বত্য অংশে মাছটির বসবাস বলে এর সংখ্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে এর জনসংখ্যা যে খুব কম এ ব্যাপারটি নিশ্চিত।"
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, "ভারতেও সাইকসম্যাটরিনকস নোকটা বেশিরভাগ আবাসস্থলে জনসংখ্যায় বিরল। কোনো কোনো জায়গায় স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত। বাংলাদেশেও এই মাছটির জনসংখ্যার আকার, আবাসস্থলের পরিসর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জৈবিক বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই। এ কারণে মাছটিকে আইইউসিএন রেডলিস্টে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রাখা হয়েছে।"
সাঙ্গু নদীর কপার মহাশোল:
শিংওয়ালা কার্পের মতোই বাংলাদেশে কেবল সাঙ্গু নদীর পার্বত্য অংশে 'কপার মহাশোল' নামের এক প্রজাতির মাছের বিচরণ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে 'করোপ মায়াল' নামে পরিচিত এই মাছ বান্দরবান জেলার সাঙ্গু নদীর রেমাক্রি অংশ ও রেমাক্রি খালে পাওয়া যায়। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম 'নিওলিসোচিলাস হেক্সাগোনোলেপিস' (Neolissochilus hexagonolepis)।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরশাদ উল আলম বলেন, "নদীর ভাটিতে এই মাছ তেমন দেখা যায় না, রেমাক্রি অঞ্চলে এর জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি। মাছটি 'আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫'-এর 'নিয়ার থ্রেটেন্ড' পর্যায়ভুক্ত হলেও বান্দরবান সদর ও এর আশেপাশের বাজারে এ মাছ বিক্রি হতে দেখা যায়।"
গবেষকরা জানান, সাঙ্গু নদী ছাড়া দেশের অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে এই মাছের উপস্থিতির রেকর্ড নেই। বাংলাদেশের বাইরে ভুটান, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এই মাছ পাওয়া যায়।
ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, "শিংয়ালা কার্প ও কপার মহাশোলসহ বেশ কয়েকটি ঝুঁকিগ্রস্থ মাছ পাহাড়ী নদীর অত্যন্ত ক্ষুদ্র ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ। পরিবেশগত কারণে এসব মাছের একমাত্র আবাসস্থলের সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী।"
তিনি আরও বলেন, "বিরল প্রজাতির এই মাছের জনসংখ্যার অবস্থা, পরিবেশ, ঝুঁকির কারণ ইত্যাদি নির্ণয়ে শুধু সাঙ্গু নদীতেই নয়, দেশের সকল পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন রয়েছে।"
চট্টগ্রামের অন্যান্য নদীর তুলনার সাঙ্গু নদীতে মাছের প্রজাতির ঘনত্ব সর্বোচ্চ। এ নদীর ১১৯ প্রজাতির মাছের মধ্যে ২৩ টি মাছ রয়েছে 'আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫'-এর তালিকায় (অতি বিপন্ন ১ টি, বিপন্ন ১১ টি ও বিপন্নপ্রায় ১১ টি)। এছাড়া, ৩ প্রজাতির বিদেশি মাছ সাঙ্গু নদীতে পাওয়া গেলেও এদের জনসংখ্যা খুবই কম।