সমালোচনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বাক স্বাধীনতা পরিপন্থী: সাবেক উপাচার্য ও অধ্যাপকদের মত

বাংলাদেশ

19 June, 2021, 07:20 pm
Last modified: 19 June, 2021, 07:21 pm
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভাজনের উভয় পক্ষের সাবেক এবং বর্তমান বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। 

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উপাচার্যকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা কিংবা কোনো পত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হলে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে, এ বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্যসহ প্রথিতযশা শিক্ষকবৃন্দ।

বিষয়টিকে বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের মুক্তচর্চার পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন তারা। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধের সাথেও এধরনের বিজ্ঞপ্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।

কোভিড-১৯ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্যের 'অপ্রাসঙ্গিক' মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'বিদ্রুপ' সৃষ্টি হলে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমের কাছে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, "গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শ্রদ্ধাশীল। একইসঙ্গে, কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সমালোচনার রীতিনীতি ও মূল্যবোধ উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটায়, তাহলে দেশের আইন যে তার প্রতিকার দেয় সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।"

সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা 'খণ্ডিত তথ্য' সংবলিত ব্যঙ্গচিত্র ও সংবাদ প্রকাশ করেছে বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

প্রাক্তন উপাচার্যগণ এবং প্রথিতযশা শিক্ষকবৃন্দ ছাড়াও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভাজনের উভয় পক্ষের সাবেক এবং বর্তমান বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। 

মজার বিষয় হলো, কেবলমাত্র প্রাক্তন শিক্ষকরা এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হন। আওয়ামীপন্থী নীল দলের শিক্ষকরা মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন। অন্যদিকে, বিএনপি-জামাতপন্থী গোলাপি দলের সদস্যদের কেবল উদ্বেগ ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

মন্তব্য করতে চাননি এরকম সুপরিচিত ব্যক্তিদের অনেকেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার এবং পত্রিকায় মতামত লিখে থাকেন।

প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী এবং অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কথা বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আরও বেশি সহনশীল হওয়ার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "আমি চিন্তার স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। যখন আমি উপাচার্য ছিলাম, তখন গণমাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। কিন্তু আমি কখনোই প্রতিবাদ করিনি। এটাই গণতন্ত্র এবং একটি সভ্য সমাজের সৌন্দর্য।"

"গণ্যমাধ্যম কখনো কখনো ভ্রান্ত তথ্য সহকারে প্রতিবেদন প্রকাশিত করে। কিন্তু, সত্যকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আসতে হয়। আর তাই, একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য হলো সহনশীলতা," বলেন তিনি।

অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, "বাক-স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো ধরনের স্বাধীনতার পথেই তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। কোনো সমালোচনার প্রতি ভিন্নমত পোষণ করলে তারা অবশ্যই তা জানাতে পারে। কিন্তু, তা অবশ্যই সঠিক পদ্ধতিতে জানাতে হবে।"

অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তচিন্তার জায়গা। সবারই সমালোচনা করার অধিকার আছে। কেউ যদি ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করে তবে বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই প্রতিবাদ জানাতে পারে, তবে তা অবশ্যই সুষ্ঠু পদ্ধতিতে হওয়া উচিত।"

বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ আট বছর সাত মাস ধরে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানানোর বিষয় উল্লেখ করে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ২১ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয় বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

"আমি আশা করি, ভবিষ্যতে তারা বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে," বলেন তিনি।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বিষয়টি 'অনভিপ্রেত' বলে মন্তব্য করেন। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলমন্ত্রের সাথে সংঘাতপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞান উৎপাদন এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে না, যা মত প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধার সৃষ্টি করে। 

"ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে সমালোচনা করা সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সকল সমাজের সাধারণ একটি চর্চা। উন্নত দেশগুলো এই চর্চা করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত উন্মুক্ত মানসিকতার সাথে এ ধরনের সমালোচনা সহ্য করা," বলেন তিনি।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার আরও বলেন, "তবে, একইসঙ্গে, সামাজিক মাধ্যমে কোনো অবমাননাকর মন্তব্য বা লেখা সহায়ক কিছু হতে পারে না। অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাদের মানহানি করে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়," বলেন তিনি।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনা এবং মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো রাজা বা পোপ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

"ব্যঙ্গচিত্রের প্রকাশনার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণবিজ্ঞপ্তি জারি করার বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং অপ্রত্যাশিত। উপাচার্য ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি কেন বিতর্কিত বিষয়টির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়কে জড়ালেন," প্রশ্ন রাখেন আসিফ নজরুল।

অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় প্রশ্নের সাথে। প্রশ্ন ছাড়া কোনো গবেষণা করা সম্ভব নয়। কখনো কখনো এটি সমালোচনার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় সমালোচনা করতে  শেখায় এবং তাকে তা অবশ্যই সহ্য করতে হবে।"

"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এর কর্তৃপক্ষ কেউ দেবতা নন। জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত কর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলে। সুতরাং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সমালোচনা অপরিহার্য," বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, "বৃহস্পতিবার জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি বাক-স্বাধীনতার পথে সৃষ্ট একটি প্রতিবন্ধকতা। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিবদের দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা।"

"বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সমৃদ্ধ করতে সমালোচনা করা অত্যাবশ্যক। বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ভালো নয়। আর তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বলতা চিহ্নিত করার এখনই উপযুক্ত সময়," বলেন তিনি।

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশি আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক এবং ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ ফেসবুকে লিখেন, "যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার উপাচার্য সামান্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে পারে না, সেই প্রতিষ্ঠান কী করে সহিষ্ণুতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার শেখাবে?"

তিনি আরও লিখেন, "নাগরিকের করের অর্থে চলা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নাগরিকরা কিছু বললে তার জন্যে 'আইনি' ব্যবস্থার হুমকি তো পাকিস্তানি আমলে ষাটের দশকেও শোনা যায়নি।"

"ভাবমূর্তির ভাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে স্বাধীনভাবে জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান বিতরণ,  জ্ঞান চর্চা  এবং সকলের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা– শিক্ষকের, শিক্ষার্থীর; স্বাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করা। এইগুলো নিয়ে ভাবলে ভাবমূর্তি নিজেই গড়ে উঠবে, তার জন্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে না।"

১০ লাখ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এক্স-স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য সংবাদ শেয়ার করে সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদক্ষেপের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

সাবেক শিক্ষার্থী মোস্তফা কামাল মোল্লা লিখেন, "মনে হয় তিনি (উপাচার্য) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভাইসরয়ের কাজ করছেন।"

আরেক সদস্য তারেক আমিন উপহাস করে লিখেন, "ভালো সিদ্ধান্ত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং বাড়বে।"
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.