লাকসাম - আখাউড়া প্রকল্পে ৫ বছরে ৭ জন প্রকল্প পরিচালক!
এক দশক ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ে একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নও করেছে রেলওয়ে। অধিকাংশ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলেও একজন কিংবা দুইজন প্রকল্প প্রধানের অধীনেই কাজ শেষ হয়েছিল। কিন্তু লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন উন্নীতকরণ প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৬ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তিত হয়েছে। প্রকল্পের কাজ ৭৪ শতাংশ শেষ হলেও বর্তমানে ৭ নম্বর প্রজেক্ট ডিরেক্টর (পিডি) দিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।
বার বার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনকেও প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসাবে দায়ী করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।
লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পটির প্রথম পিডি ছিলেন সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী। তিনি ওই সময়ে টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন প্রকল্পেরও প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় মো. লিয়াকত আলীকে। এই প্রকল্পের তৃতীয় পিডি ছিলেন মোজাম্মেল হক। প্রকল্পটির চতুর্থ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার (ডিএন মজুমদার)। এরপর প্রকল্পটির পঞ্চম প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মো. আরিফুজ্জামানকে। কিছুদিন কাজ করার পর তাকে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় রেলের বর্তমান যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) রমজান আলীকে। তাকে সরিয়ে সর্বশেষ এই প্রকল্পের ৭ম পিডি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মো. শহিদুল ইসলামকে।
প্রকল্পের শুরুতে লাকসাম-আখাউড়া ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কবলে পড়ে। বর্তমানে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ৯০ শতাংশ নিরসন হলেও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারছে না রেলওয়ে। ২৫ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় নতুন করে প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন ও প্রকল্পের কার্যকাল বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে রেলওয়ে।
জানতে চাইলে প্রকল্পটির পিডি মো. শহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। প্রকল্পটির সাবেক পিডি ও রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সাথে এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএস কে বলেন, 'শুরু থেকেই প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণ সহ বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে ছিল। এ কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিসহ বার বার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণেও চলমান অন্যান্য রেল প্রকল্পের তুলনায় কাজের অগ্রগতি কম হয়েছে। এসব কারণে লকডাউনকালীন সময়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।'
ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২১ কিলোমিটার রেলপথের ১১৮ কিলোমিটার আগে থেকেই ডাবল লাইন ছিল। ২০০৮ সালের পর দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩১ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইন করা হয়েছে। বাকী ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন হিসাবে উন্নীতকরণে এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি ২০১৬ সালের নভেম্বরে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দেয় সরকার। কিন্তু বার বার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে লকডাউনকালীন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের সুযোগ নিয়েও কাজের গতি এগিয়ে নিতে না পারায় প্রকল্পটির মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
বর্তমানে ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পটির ৭৪ শতাংশ কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এখনো প্রকল্পটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাজ শেষ করতে পারেনি তারা। গত ৪ নভেম্বর প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টকে প্রকল্পের প্রতিবন্ধকতার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় সময় বৃদ্ধি ছাড়াও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের চিঠি দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে আসলেও সেকশন-১ এ এখনো ১৬টি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এছাড়া সেকশন-২ এ ২৭৮টি প্রতিবন্ধকতাসহ প্রকল্প এলাকায় সর্বমোট ৩২১টি অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা রেলওয়ে প্রকল্পের কাজের প্রয়োজনে সরিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। এসব প্রতিবন্ধকতা ও কোভিড-১৯ এর কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আখাউড়া-লাকসাম ডাবললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। এসব কারণে ক্ষয়ক্ষতি ফলে প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এসব দাবি অস্বীকার করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া এক চিঠিতে উল্টো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি, নিম্নমানের কাজের অভিযোগ করেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মো. রমজান আলী।
চিঠিতে উল্লেখ করেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প এলাকার বিদ্যমান রেলওয়ে স্টেশনগুলো ভেঙে ফেলার আগে নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ চুক্তির শর্তে ছিল। সম্প্রতি প্রকল্প এলাকার আখাউড়া, গঙ্গাসাগর, ইমামবাড়ি, কসবা, মন্দবাগ, সালদানদী, শশীদল ও রাজাপুর সরেজমিন পরির্দশনে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ নিম্নমানের ও চুক্তিমত হয়নি বলে প্রমাণ পেয়েছে রেলওয়ে।
প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় হচ্ছে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রকল্প সহায়তা পাঁচ হাজার ৪৭৭ কোটি ৮৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পে ব্যয় করছে এক হাজার ২৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। এডিবি ও ইআইবি (ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক) রেলের এই মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। কোভিড-১৯ এর কারণে সম্প্রতি প্রকল্পটির ডিপিপি'র নির্ধারিত ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে সরকার এর মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করেছে। যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে রেলওয়ের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে প্রকল্পটির কাজ ২০২২ সালের আগে শেষ হবে না বলেই আশঙ্কা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে শুধুমাত্র লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ সিঙ্গেল লাইন রয়েছে যার নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিয়োজিত রয়েছে রেলের সিটিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার। বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিয়োজিত রয়েছে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ। প্রকল্পের আওতায় ৭২ কিলোমিটার লাইনে ১৩টি বড় সেতুসহ মোট ৪৬টি ছোট-বড় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া এই রুটে কম্পিউটারাইজড সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ আখাউড়া ও লাকসাম রেলস্টেশনসহ ১১টি বি-ক্লাস রেলস্টেশন নির্মাণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।