রোহিঙ্গা স্বামীর প্রতারণা: ২৬ দিন সন্তানসহ জেল খেটে কারামুক্তি বাঙালি নারীর
দশ বছর আগে ভালোবেসে রোহিঙ্গা যুবক সিদ্দিকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন বাংলাদেশি নারী সিরাজ খাতুন (৩৩)। কিন্তু যখন স্বামীর আসল পরিচয় জানতে পারেন, ততদিনে পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন নানা জায়গায়। একপর্যায়ে সিরাজ খাতুনের ঠাঁই হয় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ত্রাণের জন্য সিরাজ খাতুনকে তালিকাভুক্ত করা হয় রোহিঙ্গা হিসেবে। সিরাজ খাতুনের নাম সালমা খাতুন দিয়ে বাবার নাম উল্লেখ করা হয় মো. ইসহাক। ঠিকানা দেয়া হয় মিয়ানমারের। এভাবেই বাঙালী সিরাজ খাতুন হয়ে যান রোহিঙ্গা নারী!
কিছুদিন পরেই স্বামী সিদ্দিক নিরুদ্দেশ হয়ে পড়েন। অসহায় সিরাজ খাতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে ছুটে আসেন গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া গ্রাম। রোহিঙ্গা যুবকের প্রতারণার খবর শুনে হতবাক সিরাজ খাতুনের পরিবার। এরপর জীবিকার তাগিদে সন্তানসহ সিরাজ খাতুনকে ওমান পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তার পরিবার।
গত ৩ জুন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানাধীন মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গিয়ে 'রোহিঙ্গা' হিসেবে শনাক্ত হন সিরাজ খাতুন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান সিরাজ খাতুন। গত ২৬ দিন দুগ্ধপোষ্য ৯ মাসের শিশু নিয়ে কারাবন্দি সিরাজ খাতুন মঙ্গলবার আবারও তার বাংলাদেশি পরিচয় ফিরে পেয়েছেন। মুক্তি পেয়েছেন কারাগার থেকে।
অনেকটা সিনেমার মতোই শোনাচ্ছিলো মানবাধিকার আইনজীবী এডভোকেট এ এম জিয়া হাবীব আহসানের কথাগুলো। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সাংবাদিকদের কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রোহিঙ্গা যুবকের বৈবাহিক প্রতারণার শিকার হয়ে কারাবন্দি ছিলেন সিরাজ খাতুন। গত ২০ জুন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা স্বজন কুমার তালুকদারের জিম্মায় জামিননামা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমান। মঙ্গলবার আদালতের আদেশের কপিতে স্বাক্ষর করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। তার পরপরই অসহায় নারী সিরাজ খাতুন ও তার শিশু সন্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।"
"এর আগে ৪ জুন সিরাজ খাতুনকে রোহিঙ্গা হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। ওইদিন আদালত সিরাজ খাতুনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সবকিছু জেনে অসহায় সিরাজ খাতুনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেই। গত ১৬ জুন সিরাজ খাতুনকে জামিন দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৬ষ্ঠ আদালতের বিচারক মেহনাজ রহমান," যোগ করেন জিয়া হাবীব আহসান।
মামলায় অভিযুক্ত মা ও শিশুকে বিনা খরচে আইনি সহায়তা দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ)।
সিরাজ খাতুনের প্রকৃত বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া এলাকার পূর্ব খুরুশিয়া গ্রামে। বাবার নাম মৃত নুর আলম। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার যাবতীয় কাগজপত্র আছে।
সিরাজ খাতুন জানান, দশ বছর আগে রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া এলাকায় একটি মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন রোহিঙ্গা যুবক সিদ্দিক। পাশাপাশি অন্যের ফসলি জমিতে কাজ করতেন তিনি। এক সময় সিরাজ খাতুনের সাথে পরিচয় হয় তার। প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। নানা জায়গায় ঘুরেও যেন স্থির হতে পারছিলেন না তারা। একপর্যায়ে আটক হন পুলিশের কাছে। পুলিশ তাদের পাঠিয়ে দেয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
সেখানে নতুন করে পথচলা শুরু করেন দুজনে। এর মধ্যে ত্রাণের আশায় সিরাজ খাতুনকে রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। পালিয়ে বিয়ে করার পরপরই সিরাজ খাতুন জানতে পারেন তার স্বামী একজন রোহিঙ্গা। কিন্তু তখন তার আর কিছু করার ছিল না। তবে এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ শুরু হয়। সিরাজ ও সন্তানদের নির্যাতন করতে থাকে তার স্বামী। নির্যাতনে তাদের তিন সন্তানের একজন মারা যায়।
২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে যায় সিদ্দিক। এরপর থেকে সিরাজ খাতুন তার ২ সন্তানকে নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অসহায় হয়ে পড়েন। পরে বাধ্য হয়ে তাকে ছুটে আসতে হয় রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়ার সেই গ্রামে।