রাশিয়ার টিকার জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ
ভারতের টিকা পাওয়ার অনিশ্চয়তায় রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকা 'স্পুটনিক-ভি' এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী মাসে ৪০ লাখ টিকা আমদানির পাশাপাশি দেশেই ওই টিকা উৎপাদনের জন্য তোড়জোর করছে সরকার।
সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাশিয়ার করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন স্পুটনিক-ভি বাংলাদেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে তারা।
একইসঙ্গে রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রযুক্তি শেয়ারের মাধ্যমে দেশে উৎপাদন বা ভ্যাকসিনের বাল্ক এনে রিফিল করে তা প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এজন্য দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'রাশিয়ার ভ্যাকসিন ৯১% কার্যকর। সার্বিক বিবেচনায় মঙ্গলবার এ ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের জরুরি অনুমোদন দিয়েছি। পৃথিবীর ৬০টি দেশে এ ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে'।
তিনি বলেন, 'আগামী মাসে দেশে রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ৪০ লাখ ডোজ আসতে পারে। রাশিয়া থেকে 'স্পুটনিক-ভি' ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে সরকারি পর্যায়ে এবং ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম সরকারিভাবে চলবে'।
সরকারের একটি কমিটির মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে, মধ্যস্ততা করে, কত পরিমাণে আসবে, কি দাম হবে, সেটা নির্ধারণ করে এই ভ্যাকসিনটা দেশে আমদানি করা হবে বলে জানান মাহবুবুর রহমান।
স্পুটনিক-ভির অনুমোদনের পর এখন বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিনের সংখ্যা দাঁড়াল দুটি। এর আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল।
এরপর সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মাহবুবুর রহমান।
স্পুটনিক-ভি দুই ডোজের ভ্যাকসিন। এ ভ্যাকসিন ২-৮ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা যাবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, 'স্পুটনিক ভ্যাকসিনের সব ডাটা আমরা পেয়েছি। আমাদের ১২ সদস্যের পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি কমিটি এ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রিপোর্ট এবং ফেজ-ফেজ২ ট্রায়াল রিপোর্টের মূল্যায়ন করেছে'।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রাশিয়ার ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এখন দেশে মানুষকে যে কোন ভ্যাকসিন দিয়ে দেয়া উচিত। এতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কমে যাবে। যত বেশি মানুষকে দ্রুত ভ্যাকসিন দেয়া হবে তত উপকার পাওয়া যাবে'।
উৎপাদনে প্রস্তুত বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানি
টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূলত দুটি বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে উচ্চমান সম্পন্ন প্রযুক্তি এবং অন্যটি টিকা তৈরির কাঁচামাল।
রাশিয়া বা চীন কাঁচামালের ক্ষেত্রে সহায়তা দিলে টিকা উৎপাদনে সক্ষম এমন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানও দেশে রয়েছে। দেশের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের পূর্ণাঙ্গ ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। অল্প পরিসরে সক্ষমতা রয়েছে হেলথ কেয়ার ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসেরও।
দেশীয় কোম্পানির টিকা উৎপাদন সক্ষমতা যাছাই করতে ১৮ মার্চ ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের উৎপাদন প্লান্ট পরিদর্শন করে এসেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক । এই প্লান্ট থেকে এখন পর্যন্ত ১৩টি ভ্যাকসিন (ইমিউনোগ্লোবিউলিন) সফলভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে ইনসেপ্টা।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুক্তাদির বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানের আরও বেশি ওষুধ উৎপাদন করার সক্ষমতা ছিল এবং আমরা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের বার্ষিক ৬০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করতে পারব'।
'যদি আমরা ২০২৩ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে রেডি-টু ফিল ম্যাটারিয়াল বা অ্যান্টিজেন পাই তবে আমরা আমাদের দেশের সমগ্র জনগণের জন্য এই ভ্যাকসিনটি আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তৈরী করতে পারব'।
রাশিয়া কিংবা চীনের ভ্যাকসিন সরকার উৎপাদনের অনুমতি দিলে তা গ্রহণে প্রস্তুত জানিয়ে আব্দুল মুক্তাদির বলেন, 'আমরা মডার্না, ফাইজার, অ্যাসট্রাজানেকাসহ প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি। করোনার টিকা উৎপাদন সময় সাপেক্ষে এবং খুব জরুরি বলে উল্লেখ করার মতো কিছু আমরা পাইনি'।
দেশে রাশিয়ার ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হবে কিনা সে বিষয়ে মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এ বিষয়ে এখন কথাবার্তা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রস্তুতের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আমাদের দেশে তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে'।
'বিশেষ করে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস রাশিয়ান কাউন্টারপার্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে যে, ভ্যাকসিনটা আমাদের দেশে তৈরি করা যায় কিনা। এটা প্রযুক্তির হস্তান্তরও হতে পারে, আবার বাল্ক নিয়ে এসে তৈরি করাও হতে পারে। দুই ফরম্যাটেই কথাবার্তা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, আমাদের দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি হবে'।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, 'ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তর বা যে কোন কিছুতে সরকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্পষ্ট থাকতে হবে। রাষ্ট্রের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ না থাকার কারণে আমরা ভ্যাকসিন সংকটে পড়লাম। তাই দ্বিতীয়বার ভ্যাকসিন সংগ্রহের সময় যেন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়'।
দুই সপ্তাহের আগে আসছে না টিকা
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টিকা আনার ব্যাপারে কাজ করছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মার্কিন দূতাবাসে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
তবে আগামী দুই সপ্তাহের আগে কোন দেশ থেকেই টিকা আসার সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, জরুরি প্রয়োজনে করোনাভাইরাসের টিকা পেতে চীনের উদ্যোগে 'ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া' নামের প্ল্যাটফর্মে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বৈঠকে টিকা নিয়ে কথা হয়েছে। আমাদের বক্তব্যে বলেছি, যেখান থেকে পাই আমরা ভ্যাকসিন নিয়ে আসব। মানুষের মঙ্গলের জন্যে যা যা প্রয়োজন সে সব বহুজাতিক উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে বাংলাদেশ'।
বৈঠকে চীন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আফগানিস্তান, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে করোনার ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করছি। আমরা শুরুতে ভারত থেকে টিকা এনেছিলাম। কিন্তু ভারতে টিকার স্বল্পতায় তারা এখন টিকা দিতে পারছে না। ফলে রাশিয়া থেকে টিকা আনার চেষ্টা চলছে'।
এদিকে চীন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে টিকা দিচ্ছে। এর বাইরে টিকা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'চীনের কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। এসব পেলে অনুমোদন দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, উপহারের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে কিছু টিকা কিনতে হবে। সেটা আমরা চীনের সঙ্গে আলোচনা করছি।'
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকেই হোক না কেন, প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে টিকা আনতে ন্যূনতম দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে যে টিকা কেনা হবে, সেটা সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে। কারণ, রাশিয়া সরকারি পর্যায়ে কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বৈঠক থেকে ভারতকেও চীনের এই প্ল্যাটফর্মে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।