ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়োগ দিয়েছি মানবিক কারণে: সদ্যবিদায়ী রাবি উপাচার্য
বিদায়ের একদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩৭ জনের নিয়োগ নিয়ে তুমুল সমালোচনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়েছেন উপাচার্য ড. এম আবদুস সোবহান।
শনিবার পৌনে ১১টার দিকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা রাবি ক্যাম্পাসে যান। প্রথমে তারা ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহার দপ্তরে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে তদন্ত কমিটির ডাকে উপাচার্যের দপ্তরে যান সদ্য বিদায়ী উপাচার্য আবদুস সোবহান। তদন্ত কমিটি তার সাক্ষাতকার নেন।
পরে বিকেল চারটার দিকে তিনি ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এ সময় উপাচার্য বলেন, "এই নিয়োগ আইনের পরিপন্থী নয়। কারণ, উপাচার্যকে ৭৩ এর অধ্যাদেশে এ ক্ষমতা দেওয়া আছে। আমি মানবিক কারণে তাঁদের চাকরি দিয়েছি। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের এবং আওয়ামী পরিবারের।"
এদিকে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ১৩৭ জনের যোগদান স্থগিত করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করায় নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদান কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
আজ শনিবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৫ মে রাবিতে দেওয়া এডহক নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত উক্ত নিয়োগপত্রের যোগদান এবং তদসংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হলো।
রাবির বিদায়ী উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. এম আবদুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হয় গত বৃহস্পতিবার (৬ মে)। আগের দিন তিনি অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৩৭ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে যান। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নিয়োগকে অবৈধও বলেছে মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে। সদস্য সচিব হলেন- ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. জাকির হোসেন আখন্দ।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, 'শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে এই নিয়োগ অবৈধ এবং নিয়মবহির্ভুত। সুতরাং যাঁরা এই নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমরা তাঁদের সাক্ষাতকারের আওতায় এনেছি। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।'
কেন এই তদন্ত কমিটি
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সদ্য বিদায়ী ভিসি আব্দুস সোবহান তার শেষ কর্মদিবসের আগের দিন রাতে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দেন। এই নিয়োগকে অবৈধ বলেই চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষামন্ত্রণালয়।
এর আগে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানসহ বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেনসহ ২৫টি অনিয়মের অভিযোগ দেন দুর্নীতিবিরোধী'শিক্ষকরা। ইউজিসি এ পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি উপাচার্যের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগের প্রমাণও পায়। নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় গতবছরের ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে রাবিতে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত রাখাসহ ১২টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন।
দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম বলেন, সদ্য বিদায়ী উপাচার্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই একটার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছিলেন। আমরা শুরু থেকেই তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলাম। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রণায় থেকে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তার কাজ শেষ করেছে। তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
চার সাংবাদিকসহ নিয়োগ পেয়েছেন ১৪১ জন
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তাঁর শেষ কর্মদিবসে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন।
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে শিক্ষকদের আত্মীয়স্বজন থাকলেও বড় একটি অংশ আছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মী। তাঁরাই জানিয়েছেন এই সংখ্যা ৪৩। এছাড়া সাংবাদিক নেতাসহ চারজন সাংবাদিকও বড় পদে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ পেয়েছেন উপাচার্যের নাপিত ও বাসায় কাজ করা লোকও।
উপাচার্যের এমন কাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে অবৈধভাবে যেসব জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটিকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ নিয়োগ ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এম আবদুস সোবহান উপাচার্য হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিন বৃহস্পতিবার যে ১৪১ জনকে 'অ্যাডহক' (অস্থায়ী) নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন নিম্নমান সহকারী ও ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী রয়েছেন। তাঁদের নিয়োগ আদেশের তালিকায় ও নিয়োগপত্রে তারিখ রয়েছে ৫ মে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার শিক্ষক-কর্মকর্তা-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। অধ্যাপক আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শেষ দিনের বিতর্ক। এর আগে আবদুস সোবহান নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করে নিজের মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর সরকারের নির্দেশে তদন্ত করে সত্যতাও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
সাড়ে ছয় মাস আগেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। এর মাধ্যমে কম যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অথচ আগের নীতিমালা অনুযায়ী, তাঁদের আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। এ জন্য এসব নিয়োগ বাতিল এবং উপাচার্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই সব নিয়োগও বাতিল হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় পাঁচ মাস আগে কয়েকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও এরপর কার্যত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আটকে যায়। আর এই সুযোগে মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে অনিয়মের নজির সৃষ্টি করে বিদায় নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের নেতৃত্বদানকারী।
বিচার দাবি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহানের মেয়াদের শেষ দিনে সরকারের নিষেধ অমান্য করে ১৩৭ জনকে নিয়োগের ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। আজ শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানায় সংগঠনটি।
বিবৃতিতে সংগঠনের আহ্বায়ক রিদম শাহরিয়ার ও সাধারণ সম্পাদক নাহিন আহম্মেদ বলেন, '৬ মে ছিল উপাচার্য আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবস। গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পেরেছি উপাচার্য ওই দিন ১৪১ জনকে দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্যের এই নিয়োগ প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় শাসন কায়েম করতে উপাচার্য এই নিয়োগ দিয়েছেন।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'উপাচার্যের বিরুদ্ধে আগেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এই নিয়োগের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনার সৃষ্টি হলো। অবিলম্বে এই দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।'