রাজউকের আবাসিক প্রকল্প ২ দশক ধরে পানির নিচে
রাজধানীর উত্তরা আবাসিক শহরের সম্প্রসারিত তৃতীয় পর্বের (থার্ড ফেজ) ১৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কে একটি প্লটের বরাদ্দ পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম। তার প্লটটি এখনো পানির নীচে। দুই দশকের বেশি আগে, ১৯৯৯ সালে এই প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমার মতো আরও তিন হাজার মানুষের প্লট এখনো পানির নিচে। এগুলোর নকশা শুধু আমাদের কাছে রয়েছে। কবে নাগাদ প্লট বুঝে পাব, তার ঠিক নেই। তবে রাজউক আমাদেরকে প্লটের কাগজ বুঝিয়ে দিয়েছে।'
রাজউক দাবি করেছে, প্রকল্পের প্লটগুলোর উন্নয়নকাজ ৬০ ভাগ শেষ করা গেছে।
ঠিকাদার নিয়ে জটিলতার সূত্র ধরে দায়ের করা মামলায় গত দুই বছর ধরে আটকে রয়েছে উন্নয়ন কাজ। মামলার নিষ্পত্তি শেষে কবে আবার শুরু হবে কাজ, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই রাজউকের।
উন্নয়ন কাজ শেষ করার আগেই গ্রাহকদের কাছে ৫ হাজার প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে সড়ক, স্যুয়ারেজ লাইন ও ড্রেন নির্মাণ এবং পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ না থাকায় এগুলোতে বাড়ি নির্মাণ করতে পারছেন না প্লট মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরা আবাসিক এলাকার সম্প্রসারিত তিনটি সেক্টরে প্লট উন্নয়নের জন্য মাটি ভরাটে ব্যবহৃত বেশ কিছু যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
=তিন দফায় ১১ বছর সময় বাড়িয়েও কাজ শেষ হয়নি
রাজউক ১৯৯৯ সালে উত্তরা আবাসিক শহর প্রকল্পের তৃতীয় পর্বের কাজ হাতে নেয়। এজন্য ওই বছর উত্তরার দিয়াবাড়ি ও পঞ্চবটি এলাকায় ২ হাজার ৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে ৮ হাজার ২৯৫টি প্লট তৈরি করার কথা।
নতুন তিনটি সেক্টর যুক্ত করা হয় উত্তরা সম্প্রসারিত আবাসিক প্রকল্পে। সেক্টর তিনটি হচ্ছে ১৫, ১৬, ১৭।
২০০৯ সালে প্রকল্পটি সম্প্রসারণ এবং এজন্য আরও ২০০ একর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে প্রায় ১৮ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা। ফ্ল্যাটগুলো হবে ১৮ নম্বর সেক্টরে।
১৫-১৮ সেক্টরে এ পর্যন্ত ৫ হাজার প্লট উন্নয়ন শেষে প্লট মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ৩ হাজার ২৯৫ প্লটের মাটি ভরাট, সীমানা নির্ধারণ ও হস্তান্তরের কাজও এখনো শেষ হয়নি। যদিও এসব প্লটের প্রায় সবই বরাদ্দ হয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময় আগে। প্লট মালিকরা টাকাও পরিশোধ করেছেন।
প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১০ সালের মধ্যে। তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর এখন ২০২১ সালের জুনের মধ্যে তা শেষ করার কথা।
শুরুতে প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরে ব্যয় আরও ২৯৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুল আউয়াল দাবি করেছেন, বেশিরভাগ উন্নয়ন কাজই শেষ। এখন ওয়াসা পানি ও সুয়ারেজ লাইন, ডেসকো বিদ্যুৎ এবং তিতাস গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কাজ করবে।
তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পে ১২টি সেতুর মধ্যে ৮টির কাজ শেষ। আর ১৬৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় ৮০ কিলোমিটার তৈরি করা হয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগদ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
প্রকল্প পরিচালকের দেওয়া অগ্রগতির চিত্রের সঙ্গে সরেজমিন পরিদর্শন এবং প্লট মালিকদের বক্তব্যে অনেক অমিল রয়েছে।
প্লট মালিকদের একজন, সরকারি চাকরীজীবী সোহরাব হোসেন টিবিএসকে জানান, লটারির মাধ্যমে প্লট পাওয়ার পর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পুরো টাকা পরিশোধ করেছেন আরও সাত বছর আগে। কিন্তু ১৬ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর সড়কে তার প্লটের সামনে এখনো রাস্তা পর্যন্ত হয়নি। ইউটিলি সংযোগের কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়ছে না। চাইলেও প্লট মালিকরা বাড়ি নির্মাণ করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি সব জায়গাতেই কম-বেশি এক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের তিনটি সেক্টরে এখন পর্যন্ত অর্ধেকের কম এলাকায় মাটি ভরাটের কাজও শেষ হয়নি। কোনো কোনো এলাকায় সড়কের কাজ ধরাও হয়নি। পানি, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনের কাজ শুরু হয়নি। বিদ্যুতের তার মাটির নিচে স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও কাজ ধরা হয়নি।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. কাওসার আমির আলী টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য আমরা চাহিদাপত্র পেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখানে কাজ করার পরিবেশ তৈরি হয়নি।'
ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) মো. মাহমুদ হোসেনও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, সড়ক ও প্লট উন্নয়নের কাজ শেষ না হলে পানির সংযোগ, স্যুয়ারেজ লাইন বা ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
= মামলায় আটকে রয়েছে উন্নয়ন কাজ
প্রকল্পে প্লট ও সড়ক উন্নয়নের জন্য দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজউক চুক্তিবদ্ধ হলেও অনিয়মের কারণে ২০১৬ সালে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়। উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরবর্তীকালে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে রাজউক।
কিন্তু আগের দুই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চুক্তি বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরই আদালতে মামলা করে। দুই বছর পর আদালত ২০১৮ সালের ৪ মার্চ নতুন দুই ঠিকাদারের সঙ্গে করা রাজউকের চুক্তির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। বন্ধ রয়েছে উন্নয়ন কাজও।
মামলা দায়ের করা দুই প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল টিবিএসকে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন ঠিকাদাররা কাজ করতে পারবেন না।
তিনি জানান, আগামী ২৮ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানি। ওইদিন একটি রায় আসতে পারে। রায়ে আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ হবে।
= নতুন ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ঝামেলা
নতুন দুই ঠিকাদার মেসার্স ইভা ভারসীজ কর্পোরেশন ও মেসার্স মার্স সিন্ডিকেটেরর কর্মকর্তারা জানান, আগের ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ার পর রাজউক তাদেরকে যে সাইট বুঝিয়ে দিয়েছে, তা ভরাট করতে মাটি লাগবে প্রায় ৫ লাখ ৪ হাজার ঘনমিটার। অথচ তাদেরকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ঘনমিটারের।
তারা বলেন, 'তারপরও ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমরা কাজ চালিয়ে যাই। আমরা প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫৫৬ ঘনমিটার মাটি ভরাট করেছি। এই কাজের একটা বড় অংকের বিল এখনো বকেয়া পড়ে আছে। এখন আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে রাজউক।'
তারা জানান, মাটি ভরাট শেষ না হলে সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, মামলার নিষ্পত্তি হলে প্রকল্পের জায়গা আবার জরিপ করে পুনরায় নতুন ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। তাদের সঙ্গে কোনো সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা হবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, আগামী বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী বছরের শেষ দিকে এসে প্লট মালিকরা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবেন।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, যেভাবে এতদিন কাজ হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরও এক দশক লেগে যাওয়া বিচিত্র হবে না।