যেভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা
২০০৭ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ দশমিক ৬৫ টাকা। প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়ে ডলারের দাম উঠেছে ৮৪ দশমিক ৮০ টাকায়। পদ্মা সেতুতে ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধের কারণে তা টাকার অবমূল্যায়ন ব্যয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
প্রকল্পের আওতায় মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৫৭০ মিটার বাড়াতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৮ হাজার ৪৬৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আওতা না বাড়লেও নদী শাসনে ব্যয় বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
নতুন যোগ হওয়া ইয়ার্ড নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা, আর্কাইভ ও ফিল্ম বাবদ ব্যয় ১০ কোটি টাকা, সেতু কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ৬২ কোটি টাকা, সেতু ভবন সম্প্রসারণে ৩০ কোটি টাকাসহ মূল সেতুতে ছিল না এমন অনেক খাত যোগ করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
২০০৭ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় এর ব্যয় উঠেছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায়।
১০ বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে প্রকল্পটির ব্যয় ২০ হাজার ৩১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বেড়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে চার দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পটির ব্যয় উঠেছে মূল বরাদ্দের প্রায় তিনগুণে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। সংশোধনের মাধ্যমে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। এ হিসাবে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে প্রায় সাত বছর।
অবশ্য এ সময়ে মূল সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হলেও দেড় হাজারের বেশি রোডস্ল্যাব ও হাজারের বেশি রেলস্ল্যাব বসানো, সেতুর রেলিং, স্ল্যাবের ওপর পিচ ঢালাইয়ের কাজ, আলোকসজ্জা, ল্যাম্পপোস্ট বসানো এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন সংযোগের কাজ বাকী আছে।
এ সব কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর ফলে আরেক দফায় ব্যয় বাড়বে বলেও আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
মূল সেতুর ব্যয়
২০০৭ সালে প্রণয়ন করা মূল প্রকল্পে রেলট্র্যাকসহ ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৬৬৩ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতে সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারে উন্নীত করে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায়।
তবে কয়েক দফায় টেন্ডার আহ্বানের পর উপযুক্ত ঠিকাদার না পাওয়ায় চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেয়।
এর ফলে প্রত্যেকটি খাতেই ব্যয় বেড়ে গেছে ৮ হাজার ৪৬৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
নদী শাসন
প্রকল্পের ১৬ কিলোমিটার নদীশাসনের বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২ হাজার ৬১২ কোটি ৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ সংশোধনীতে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় বেড়েছে ৬ হাজার ৭৮৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা যা মূল বরাদ্দের সাড়ে তিনগুণ।
সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া
১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে ৩৬০ কোটি ২৩ লাখ টাকার বরাদ্দ উঠেছে ১ হাজার ৯০৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকায়। বেড়েছে ১ হাজার ৫৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা যা ৫ দশমিক ২৮ গুণ।
পুনর্বাসন
৩০৬ কোটি ৫ লাখ টাকার পুনর্বাসন ব্যয় উঠেছে ১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকায়। বেড়েছে ১ হাজার ২০৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা যা ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
ভূমি অধিগ্রহণ
প্রকল্পের আওতায় শুরুতে ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ৫২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অধিগ্রহণের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩০ দশমিক ৫৪ হেক্টরে উন্নীত করে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকায়। এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৭৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ বাড়তি ভূমি অধিগ্রহণ করতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ১৪৬ শতাংশ।
প্রকল্পের নদী শাসনের ড্রেজিং থেকে উঠে আসা মাটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যায়ে এসে নতুন করে ১ হাজার ১৬২ দশমিক ৬৭ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করা হয়েছে।
নতুন যোগ হওয়া কাজ
মূল প্রকল্পে না থাকলেও সংশোধিত প্রকল্পের প্রস্তাবে ইয়ার্ড নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেতু কর্তপক্ষের সক্ষমতা বাড়াতে এ প্রকল্প থেকে ব্যয় করা হয়েছে ৬২ কোটি ১০ লাখ টাকা। সেতু প্রকল্পের আওতায় সেতু ভবন সম্প্রসারণে ব্যয় হচ্ছে ৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আর্কাইভ ও ফিল্ম বাবদ ব্যয় ১০ কোটি টাকাও বরাদ্দ রয়েছে প্রকল্পটিতে।