যেন প্লাস্টিকের নদী
বার-তেরো বছর আগে বংশী এবং বুড়িগঙ্গা নদীর সংযোগ হিসেবে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণের পরিচিত একটি নৌপথ ছিল কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট নদী। স্থানীয়ভাবে বুড়িগাং নামে পরিচিত এ নদীটির এখন অবস্থা এমন, এটিকে দেখলে খালও মনে হয় না। নদীর পানির জায়গা দখল করে নিয়ে প্লাস্টিক পণ্যসহ বিভিন্ন বর্জ্য।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, নদীর মাঝে ও দুই পাড়ে ময়লার ভাগাড়। যেসব ময়লার মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল বা পলিথিন। আশপাশের বাসিন্দা ও দোকানিদের সমস্ত ময়লা প্রতিদিন নিয়ম করে এই নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য দিয়ে নদীটি এমনভাবে ভরে আছে যে কোনো দিকে আর পানি চলাচলের অবস্থা নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ এই প্রতিবেদকের কাছে একে প্লাস্টিকের নদী বলেও মন্তব্য করছেন। আবার তারাই স্বীকার করলেন ব্যবহার শেষে প্লাস্টিকের উচ্ছিষ্টগুলো তারাই নদীতে ফেলছেন।
কামরাঙ্গীর চরে প্রায় ২০ বছর ধরে বসবাস করছেন মো. সেলিম। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘দুই-তিন মাস পরপর সরকারের লোকজন এসে নদীর বিভিন্ন জায়গায় ময়লা তুলে নিয়ে যায়। আমরাই আবার ময়লা ফেলে এটা ভরাট করে ফেলি।’
একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিকের দাপটে এই নদীটি মরে যাওয়া এখন দৃশ্যমান। শুধু এই নদীটিই নয়, সারাদেশের বিভিন্ন খালবিল, নদনদী বা সমুদ্রে এখন অহরহ মিলছে এসব প্লাস্টিক পণ্য। মাটি ও পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট করতেও এ পণ্যগুলোর জুড়ি নেই বলে এখন তা বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) জরিপ অনুযায়ী বার্ষিক ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। দেশে ব্যবহৃত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-প্লাস্টিকের স্ট্র, কটনবাড, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, প্লাস্টিক, ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্লাস্টিক কৃষি জমি,পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে এসব প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পলিথিনসহ হিসাব করলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়।
এসডোর গবেষণায় দেখা গেছে, এসব প্লাস্টিকের ২২ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এবং ৭৮ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে শহরে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে ফুড প্যাকেজিং খাতে। বছরে প্রায় ৫৪ হাজার প্যাকেট বর্জ্য হিসাবে আসছে। এরপরই রয়েছে কটনবাড, শ্যাম্পু, পেস্টের টিউব এবং স্ট্র। এসব পণ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, এয়ারলাইন্স, সুপারশপ ও কমোডিটি পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো।
একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাব
পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করে এমন সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, মানুষ একবার ব্যবহার করে যখন এই প্লাস্টিকগুলো ফেলে দিচ্ছে তখন এগুলো মাটি এবং সেখান থেকে পানিতে গিয়ে পড়ছে। শহরের বিভিন্ন ড্রেন দিয়ে এগুলো নদীতে পড়ছে, নদী থেকে যাচ্ছে সমুদ্রে।
মাটি বা পানিতে যাওয়ার পর কোন কোন পণ্য দুই থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। যেসব প্লাস্টিক ভেঙে যায় সেগুলো মাইক্রো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের দানায় পরিণত হয়। এগুলো শত শত বছর মাটি বা পানিতে একইভাবে থেকে যায়, যা কখনোই ডিকম্পোজড হয় না। এগুলো মাটির আঠালো ভাবকে কমিয়ে উর্বরতা নষ্ট করছে, পানিতে থাকা মাছ এসব খাওয়ার কারণে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন প্লাস্টিকপণ্য বা কণাগুলো জমে থাকার কারণে নির্দিষ্ট স্থানের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে থাকে।
গবেষকরা বলছেন, উদ্বেগের বিষয় বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে যা প্রাণিকুল ছাড়াও মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
এ বিষয়ে এসডোর মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘প্লাস্টিকের কণাগুলো খুবই ক্ষতিকর। এগুলো শত শত বছর টিকে থাকে এবং মাটি ও পানির স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। মাছ এগুলোকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে এবং মারা পড়ছে। পানির দূষণ হলে সেখানে মাছের বংশ বিস্তারেও সমস্যা হবে।’
প্যাকেজিং এর সঙ্গে ব্যবহার করা প্লাস্টিক পণ্যগুলো নিয়মিত মানুষ ব্যবহার করছে। এই প্যাকেটগুলোতে ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের রং। রংগুলো আসলে এক ধরনের কেমিকেলের মিশ্রণ। বাংলাদেশে সাধারণত ১৮-২২ ধরনের রং ব্যবহার হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এর গবেষণার তথ্য বলছে, বিভিন্ন ধরনের রং তৈরিতে সারা বিশ্বে প্রায় ১১ হাজার কেমিকেল ব্যবহার করা হচ্ছে। যেগুলোর বড় উপাদান লেড, ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের ভারি ধাতু।
গবেষকদের দাবি, বাংলাদেশে ফুড প্যাকেজিং এ যেসব প্যাকেট ব্যবহার হচ্ছে তার অধিকাংশই নিম্নমানের। একে তো নিম্নমানের প্যাকেট তার ওপর যেসব রং ব্যবহার করা হয় সেগুলো ফুড গ্রেডের নয়। যে কারণে খাবারগুলো দূষিত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। বিশেষ করে গরমকালে কেমিকেলগুলো গলে যায়, নির্গত হয়ে খাবারের সঙ্গে মিশে যায়। ভারি ধাতুগুলো খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে হয়তো স্বল্প মেয়াদের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কিডনির ক্ষতি করছে এবং ক্যান্সারের মত মারাত্নক রোগের কারণ হতে পারে।
তবে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা প্যাকেজিং এ যেসব প্লাস্টিক ব্যবহার করি সেগুলো ফুড গ্রেডের। যে কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ব্যবহার করা প্যাকেটটির আসলে শেষ পরিণতি কি হয় তা নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
বিদেশ থেকেও আসছে প্লাস্টিক বর্জ্য
কক্সবাজারের ইনানি সি বিচে সম্প্রতি একটি পণ্যের প্যাকেট পাওয়া যায়, যার উৎপাদন হয়েছে ব্রাজিলে। গবেষকরা ধারণা করছেন, সামুদ্রিক চ্যানেলের ম্যধ্যমে এই প্যাকেটগুলো ভেসে ভেসে আসছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। বাংলাদেশের সমুদ্রের পানিতে ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারের অনেক প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা নদী দিয়ে প্রায় ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা নদীর মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তবে এই অংশটা বঙ্গোপসাগরের মোট প্লাস্টিক বর্জের মাত্র ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশই আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে।
এ বিষয়টি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক নদী কমিশনের আইনের আওতায় ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকারের আলোচনায় বসা উচিত বলে মনে করেন এসডোর মহাসচিব শাহরিয়ার হোসেন।
একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপ
থাইল্যান্ড গত ৫ জানুয়ারি খাদ্যপণ্যের মোড়কে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে বলে জানা গেছে। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারত প্লাস্টিক ব্যাগ অঞ্চলভিত্তিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করছে এবং সারাদেশে একেবারে ২০২২ সালে বন্ধ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার সারা বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং তা প্রায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তখন পলিথিনের ব্যবহার একেবারে কমে আসলেও এখন আবার যত্রতত্র উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে। তবে আইনের প্রয়োগ এখানে ব্যাপক ঢিলেঢালা।
তবে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের সকল হোটেল, মোটেল এবং রেস্তোরাঁয় এক বার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিকপণ্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে ও সকল উপকূলীয় অঞ্চলে পলিথিন/প্লাস্টিকের ব্যাগ বহন, বিক্রয়, ব্যবহার, বিপণন নিষিদ্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ আগামী ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারির মধ্যে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা কার্যকর এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ধারা ৬(ক) এর অধীন এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত বলে গণ্য হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট এই রুল জারি করেন।
আদালত দেশব্যাপী নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ, কারখানা বন্ধ এবং যন্ত্রপাতি জব্দ করণের মাধ্যমে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিদ্যমান আইনী নিষেধাজ্ঞা পূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারকে পুনরায় নির্দেশ দিয়েছেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশ পালনের জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল কোর্ট চালানো হচ্ছে। সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে, যাতে মানুষ এ বিষয়ে সচেতন হতে পারে।’
প্লাস্টিক বন্ধের বিষয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেই বলে জানান মন্ত্রী। তবে আবারও পলিথিন বন্ধের জন্য দ্রুতই জোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।