মৌলভীবাজারের রাধানগর গ্রাম এখন পর্যটন কেন্দ্র
পাখির চোখে দেখলে মনে হবে একটি সবুজ শ্যামল সংরক্ষিত ঘন বন। তবে শীঘ্রই বনের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ৫ তারকা হোটেল এবং আরেকটি ৭ তলা বিশিষ্ট ৩ তারকা হোটেলের ছাদ চোখে পড়বে। পাখির চোখে যতই সবুজ বন মনে হোক, এটি আসলে কোন বন নয়, একটি গ্রাম। সে গ্রামের বাঁকে-বাঁকে গড়ে উঠেছে আধুনিক রিসোর্ট, কটেজ। এখানে একটি মাত্র গ্রামে রয়েছে ৫ তারকাসহ ২৫ টি রিসোর্ট, কটেজ। পরিকল্পনায় এবং নির্মাণের অপেক্ষায় আরও অন্তত ২৫টি রিসোর্ট-কটেজ। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ব্যবসা করছেন এখানে। কেউ হোটেল রিসোর্ট দিয়েছেন, কেউ খাবার হোটেল আবার কেউবা পরিবেশনের কাজ করছেন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকে এই গ্রাম।
এই গ্রামের নাম রাধানগর। পর্যটনের ছোঁয়ায় বদলে গেছে এই গ্রাম। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একসময়ের অজপাড়া গ্রাম রাধানগর পর্যটনের সুবাদে আজ আজ সারাদেশে পরিচিত। শুধু তাই নয়, এই গ্রামের একটি রিসোর্ট নিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী 'দ্য ইকোনমিস্টে' একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
সরেজমিনে রাধানগর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ৫ তারকা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান দিয়ে শুরু এই গ্রামের সামনের অংশ। যতই সামনে যাওয়া যায় চোখে পড়ে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, ইকো কটেজ। মোট ২৫টি হোটেল রিসোর্ট রয়েছে এই গ্রাম শ্রীমঙ্গল ঘুরতে আসা পর্যটকদের বড় একটি অংশ থাকার জন্য এই গ্রামকেই বেছে নেন। এখানে রয়েছে ১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা মানের রুম। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ পর্যটক এখানে অবস্থান করেন।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার তথ্য মতে, শহরের কোলাহল থেকে শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা পর্যটকরা রাধানগর গ্রামকেই পছন্দ করছেন। শুধু দেশের নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছে পছন্দের শীর্ষে রাধানগর। যার কারণে এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই গ্রাম।
পর্যটনকেন্দ্রিক আয়ে বদলে গেছে এই গ্রামের পুরো চিত্র।
আরও ২৫টি রিসোর্ট নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১ হাজার মানুষের। জায়গার দাম বেড়েছে গত ১০ বছরে ৫০ গুণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটন ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে এসে বিনিয়োগ করছেন।
রাধানগর গ্রামে ঘুরে পাওয়া গেলো শামছুল হক নামের একজন পর্যটন ব্যবসায়ীকে যিনি আজ থেকে ১৪ বছর আগে এই গ্রামে প্রথম ইকো কটেজ গড়ে তুলেন। শামছুল হক বর্তমানে শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
তিনি জানান, একসময় মুদি দোকানের পাশাপাশি লেবু বাগান গড়ে তোলেন। কিন্তু দিনে দিনে শ্রীমঙ্গল পর্যটন সমৃদ্ধ হওয়ায় তিনি বুঝতে পারেন, এই খাতে ব্যবসা হতে পারে লাভজনক। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে লেবু বাগানের ভেতরে এক রুমের একটি ইকো কটেজ করেন। ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া পাওয়ায় পরে তিনটি কটেজ গড়ে তোলেন শামছুল। ২০১৮ সালে এই কটেজের সামান্য দূরে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আরেকজনের সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন আরও ৫টি কটেজ।
সব মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে এখন সফল তিনি। পাশাপাশি তার এখানে সরাসরি এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৩০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। গাড়িচালক, ট্যুর গাইডসহ অন্তত ২০০ মানুষের জীবিকার উৎস তার এই কটেজগুলো.
শামছুল হকের মতো বিনিয়োগ করতে না পারলেও পর্যটন বদলে দিয়েছে রাসেল আলমের জীবন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি হাউস টিউটর হিসেবে পথচলা শুরু করেন। এরইমধ্যে ২০০৫ সালে আকৃষ্ট হন ইকো ট্যুরিজমের প্রতি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ট্যুর গাইড হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন রাসেল। কিছুদিনের মধ্যেই তার আয় বাড়ে কয়েকগুণ। বর্তমানে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন রাসেল। তিনি অন্তত ১৫ জন গাইডকে চেনেন, পর্যটন যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে.
ব্যবসায়ীদের কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামে প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। পর্যটন খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ২০০ কোটির কাছাকাছি। চা শিল্পের পর পর্যটনখাতকেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সংশ্লিস্টরা। বিনিয়োগ যত বাড়ছে ততই বাড়ছে এই এলাকার জায়গার দাম।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বিশ্বজিৎ দেববর্মা জানান, ১০-১৫ বছর আগে এখানে জায়গার দাম ছিল শতকে ১০-১৫ হাজার টাকা কিন্তু বর্তমানে ৫-৬ লক্ষ টাকা শতক বিক্রি হচ্ছে এমন অনেক জায়গা রয়েছে। জায়গার দাম যত বাড়ছে ততই বাড়ছে জায়গা সংক্রান্ত ঝামেলা।
'আমার বাড়ী' রিসোর্টের পরিচালক সজল দাস বলেন, "রাধানগর গ্রামের পরিবেশ পর্যটনবান্ধব তাই কয়েক বছর আগে আমি এখানে ব্যংক লোন নিয়ে ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। ভালই সাড়া পাচ্ছি। করোনার কাছে আমাদের কিছুটা ক্ষতি হলেও স্বাভাবিক সময়ে এখানে পর্যটকের অভাব নেই। বরং শুক্র-শনিবারে অনেক রিসোর্টের রুম ১ মাস আগেই বুকড হয়ে যায়।"
রাধানগর গ্রামে 'চামুং রেস্টুরেন্ট এন্ড ইকো ক্যাফে' নামে একটু রেস্টুরেন্ট চালু করছেন কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা। তাদের একজন তাপস দাস বলেন, "লাভের প্রবল সম্ভাবনা আছে বলেই আমরা কজন তরুণ উদ্যোক্তা এই খাতে বড় একটি বিনিয়োগ করতে উৎসাহ বোধ করি। শীঘ্রই আমাদের প্রতিষ্ঠান চালু হবে। ধারণা করছি আমরা প্রতিদিন ৫০০ এর বেশি পর্যটক আমাদের এখানে গ্রাহক হিসেবে পাব।"
রাধানগর গ্রামে ২০১৫ সালে 'শান্তি বাড়ি' নামে একটি ইকো কটেজ প্রতিষ্ঠিত হয় যা এখন দেশ-বিদেশে পরিচিত; ২০১৯ সালের ৬ মে এই ইকো কটেজটিকে নিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী 'দ্য ইকোনমিস্টের' একটি সংখ্যায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি বিদেশিদের কাছে এই গ্রামকে নতুনভাবে তুলে ধরে। এরপর থেকে বিদেশিদের আগ্রহ আরও বেড়েছে।
'শান্তি বাড়ির' প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভিরুল আরেফিন লিংকন বলেন, "আমাদের এখানে ৩০ জনে্র থাকার ব্যবস্থা আছে। আমাদেরটা শতভাগ ইকো। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে ইকো-টুরিজমের চাহিদা বাড়ছে। গত কয়েক বছর যে পরিশ্রম আমরা করেছি তাতে মানুষকে বুঝাতে পেরেছি যে, এসি-টেলিভিশন ছাড়াও বাঁচা যায়। তাই শান্তি বাড়ি এখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় নাম।"
স্থানীয় প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই গ্রামে জনপ্রিয় ছিল আখচাষ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে, বিশেষ করে আখ ব্যবসায়ী এবং এর সাথে সংশিষ্ট শ্রমিকরা এখানে বসবাস শুরু করেন। এরপরে আস্তে আস্তে লেবু চাষ এবং কাঁঠাল বাগান জনপ্রিয় হতে থাকে। এখনো এই এলাকায় লেবু বাগানের অস্থিত্ব চোখে পড়বে রয়েছে, আছে কাঁঠাল বাগানের চিহ্নও। তবে ২০১০ সাল থেকে এখানে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা জনপ্রিয় হতে থাকে যা ২০১৫ সালে এসে বেগবান হয়। বর্তমানে প্রতিনিয়ত নতুন ব্যবসা তৈরী হচ্ছে পর্যটকদের টার্গেট করে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি মেন্যুর খাবার হোটেল, হস্তশিল্পের দোকান, এছাড়াও রয়েছে এই এলাকার প্রধান শিল্প চা পাতার বিক্রয়কেন্দ্র।
শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, "পর্যটন বিকাশে এবং গ্রামীণ উৎপাদনশীল খাতসমূহকে পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত করতে সরকার 'গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটন' ধারণা নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে পর্যটন একটা গ্রামের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কিভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাধানগর গ্রাম। এই গ্রামটি ইকো-ট্যুরিজমের জন্যও উদাহরণ। আমরা এই গ্রামে পর্যটন বিকাশে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। দিন-রাত এখানে পর্যটকরা নিরাপদে চলতে পারেন।
গত পাঁচ বছরে এখানে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার রেকর্ড নেই, যা প্রমাণ করে এই জায়গাটি কতটা পর্যটনবান্ধব। নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে, সেই সাথে আমরাও সচেতন যেনও কোনভাবেই পরিবেশ-প্রকৃতি নষ্ট না হয়। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তার অর্থনৈতিক সুবিধা, শ্রীমঙ্গল শহরসহ আশেপাশের সকল এলাকা পাচ্ছে।"