মাছের বৈচিত্র্য কমছে কাপ্তাই হ্রদে,বিলুপ্ত অনেক প্রজাতি
১৯৬০'র দশকে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয় কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। যার ফলে বিশাল এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় ৩৫৬ বর্গমাইল আয়তনের সুবিশাল কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। নবসৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষ শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)।
এক সময় এ হ্রদে রুই, কাতলা, সরপুঁটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা মাছের মতো দেশী-বিদেশী বড় মাছ পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে ক্রমশ জৌলুস হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদের মাছ। বস্তুত হ্রদে মৎস্য উৎপাদন বাড়লেও কমেছে রুই জাতীয় মাছ। বিলুপ্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতি। প্রতিবছর নিয়ম করে কাপ্তাই হ্রদে রুই জাতীয় মাছের পোনা ছাড়ে বিএফডিসি,তবে বিলুপ্ত মাছের প্রজাতিগুলো হ্রদে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ নেই তাদের। অন্যদিকে হ্রদের মাছের গবেষণার দায়িত্বে থাকা বিএফআরআই,বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিগুলো ফের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কথা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কাপ্তাই হ্রদ দুই প্রজাতির চিংড়িসহ মোট ৭৫ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল। এর মধ্যে ৬৭টি প্রজাতির মাছ দেশীয় এবং ৮ প্রজাতির মাছ বিদেশি।
তবে বিএফআরআইয়ের হিসেবে ৭৫ প্রজাতির মাছ থাকলেও বিএফডিসির কাছে প্রায় ৪২ প্রজাতির মাছের বিপণন হিসেব পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত। কোন কোন প্রজাতির মাছের বাৎসরিক অবতরণ হিসেবও নেই, এর মধ্যে সাদা ঘনিয়া, মহাশোল, সরপুটি, মাগুর, কার্পিও, পোয়া, ফাইস্যা, কাকিলা মাছ অন্যতম।
বিএফআরআই রাঙামাটি নদী-উপকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থবছরে কাপ্তাই হ্রদে রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন ছিল ২৫৮ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন; যা বর্তমানে ৫৩ দশমিক ২ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে ছোট মাছের উৎপাদন ২০০২-০৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪০০ দশমিক ১৯ মেট্রিকটন; যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৭৪ দশমিক ১৩ মেট্রিকটন। এতে করে রুই জাতীয় মাছের বাণিজ্যিক উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৮১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে। অন্যদিকে ছোট মাছ ৮ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে ছোট মাছের মধ্যে বিশেষ করে কেচকি, চাপিলা ও মলা মাছের আধিক্যই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, কেচকি, চাপিলা, কাঁটা মইল্যা, দেশী মলা, তেলাপিয়া, কালিবাউস আইড়, বাটা ও ফলি মাছ। এর মধ্যে কেচকি, চাপিলা, কাঁটা মইল্যা, দেশী মলা এই চার প্রজাতির মাছ ছোট মাছ।
এছাড়া হ্রদে মজুদকৃত মাছের মধ্যে রয়েছে, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, মোজাম্বিকা তেলাপিয়া, গিফট তেলাপিয়া, মহাশোল, আফ্রিকান মাগুর, বিগহেড কার্প ও থাই পাঙ্গাস। এর মধ্যে আট প্রজাতির মাছ বিদেশি প্রজাতির মাছ।
কাপ্তাই হ্রদে ক্রমহ্রাসমান প্রজাতিসমূহের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতল, মৃগেল, বাঁচা, পাতি পাবদা ও বড় চিতল। বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যে রয়েছে, দেশী মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলসা ও সাদা ঘনিয়া। ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত সীলন, দেশী সরপুঁটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মোহিনী বাটা ও দেশী পাঙ্গাস।
বংশানুক্রমে গত তিন দশক ধরেই কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণ করে সংসারের হাল ধরেছেন হরি জলদাশ। হরি জানালেন, 'আগেকারদিনে কাপ্তাই হ্রদে যে সব প্রজাতির বড় বড় পেতাম, সেগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। চিতল, মহাশোল, বাঘাইড়, সিলভার কার্পসহ এসব মাছ এখন নেই বলতেই চলে। লেক এখন কেচকি-চাপিলার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ছোট প্রজাতির মাছই এখন বেশি ধরা পড়ছে'।
রাঙামাটির প্রবীণ নাগরিক সুনীল কান্তি দে বলেন, 'আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন পয়েন্টে চিতল, মহাশোলসহ বড় বড় নানান মাছ পাওয়া যেত। আমি নিজেও বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মীয়-পরিজনদের কাছে কাপ্তাই হ্রদের মাছ পাঠাতাম। এখন আর বড় বড় এসব মাছ পাওয়া যায়। তাই অনেকে চাইলেও পাঠাতে পারিনা। হ্রদে মাছের দুর্দিন চলছে'।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি হারুনুর রশীদ জানালেন, 'দেশের বাজারে ছোট মাছের চেয়ে বড় মাছের চাহিদা প্রচুর। অথচ কাপ্তাই হ্রদে এখন বড় মাছ তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে হ্রদের তলদেশ ভরাটের কারণে গভীর জলাশয়ের অভাবে বড় মাছ বা গভীর জলের মাছের সংখ্যা কমছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে হ্রদে পোনা ছাড়লে হ্রদের পানি স্বল্পতার কারণে জেলেদের কেচকি জালে রুই জাতীয় মাছের পোনা ধরা পড়ে যায়। এসব কারণে কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন কমছে'।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'আগের চেয়ে এখন মাছ উৎপাদন বাড়লেও একটা সময় রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন বেশি ছিল, এখন একেবারেই কমে গেছে। অন্যদিকে ছোট প্রজাতির মাছ বেড়েছে। কাপ্তাই হ্রদে মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টির অবস্থা নেই। প্রতিবছর কেবল তিনমাস নয়, প্রয়োজনবোধে মাছ আহরণের নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া জেলেরা যাতে পোনা মাছ ধ্বংস করতে না পারে সে ব্যাপারে বিএফডিসিকে পাহারার ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই আগের মত, কাপ্তাই হ্রদে বড় মাছের সংখ্যা বাড়ুক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে তা হারাতে বসেছে'।
কাপ্তাই হ্রদে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) রাঙামাটি নদী-উপকেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিএম শাহিনুর রহমান জানান, বিএফআরআইয়ের সর্বশেষ সরকারি হিসেবে ৭৫ প্রজাতির মাছের কথা বলা হলেও সব প্রজাতির মাছ এখন আর কাপ্তাই হ্রদে পাওয়া যায় না। দেশী মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, তেলে গুলসা ও সাদা ঘনিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রুই, কাতল, মৃগেল, বাঁচা, পাতি পাবদা ও বড় চিতল এই প্রজাতিগুলো ক্রমহ্রাসমান প্রজাতির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'বিএফডিসির তালিকায় যেসব প্রজাতির মাছের নাম উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যেও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বিরল প্রজাতির কিছু মাছ ধরা পড়লেও অনেকাংশে আমাদের নজরে আসে না। কাপ্তাই হ্রদে বর্তমানে ছোট মাছের আধিক্য বেশি। আমাদের রাজস্ব আদায়ের মূল অংশ আসে ছোট প্রজাতির মাছ থেকেই। তবুও আমরা হ্রদে রুই জাতীয় উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছরই পোনা অবমুক্ত করে আসছি'।
বিএফআরআই রাঙামাটি নদী উপকেন্দ্রের প্রধান ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আজহার আলী বলেন, 'হ্রদে গড়ে উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, তবে বড় মাছের আধিক্য কমেছে। যেখানে ১৯৬৫-৬৬ অর্থবছরে হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন ছিলো ৮১ শতাংশ। এখন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৫ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। কীভাবে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন পূর্বের দিনের মতো ফিরিয়ে আনা যায়, আমরা সে ব্যাপারে গবেষণা করছি'।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬২ সালে বাঁধ নির্মাণ শেষে রাঙামাটির বিশাল এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদই বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এর আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। যা বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এ হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি রাঙামাটিতে মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। এ হ্রদের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে প্রায় ২২ হাজার জেলে।
জেলে ও ব্যবসায়ীদের মতে, কাপ্তাই হ্রদের পাঁচটি চ্যানেলে মাছ উৎপাদন হলেও বর্তমানে লংগদুর কাট্টলী-মাইনি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। তবে অন্য চারটি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। যার মধ্যে বর্তমানে চেঙ্গী নদী আর রাইংখ্যং নদীর চ্যানেলে প্রজনন ক্ষেত্রগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
নদীর তলদেশ ভরাট আর নদীর প্রবাহ কমায় এ অবস্থার সৃষ্টি। অন্যদিকে কাচালং নদী, মাইনি নদীর সংযোগ এলাকায় এবং কর্নফুলী নদীর বরকল এলাকার জগন্নাথছড়া এলাকায় প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে কিছু সংখ্যক রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হলেও সেগুলো এখন নষ্ট হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অবশ্য তারা কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাটকে দায়ী করছেন।