ভ্যাকসিন সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাস্টারপ্ল্যান
দেশে করোনাভাইরাসের টিকা কর্মসূচী শুরুর পর প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখের বেশি মানুষ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ভ্যাকসিন না আসায় এখন খুব অল্প সংখক মানুষ প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। এবং প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া সবার দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ টিকাপ্রদান কর্মসূচী এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে সুষ্ঠু কার্যক্রম। এই প্রথম সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেবা নিয়ে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু ভ্যাকসিনের ডোজ সংকটের কারণে টিকা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণ-টিকাদান কর্মসূচী উদ্বোধন করে। ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন দেশের ১০০৫টি কেন্দ্রে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচী শুরুর প্রথম সপ্তাহে দিনে গড়ে ১ লাখ ২৯ হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। কর্মসূচীর দ্বিতীয় সপ্তাহে দিনে গড়ে ২ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন ভ্যাকসিন নিয়েছেন, যা একদিনে সর্বোচ্চ। তবে এখন দিনে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার সংখ্যা ১৫ হাজারে নেমে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, টিকাদান কর্মসূচী শুরুর প্রথম দুই মাসে ১ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা ছিল। সরকার ৫ মাসের মধ্যে দেড় কোটি মানুষকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আড়াই মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ৫৭ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ। ৭ এপ্রিল থেকে দেশে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়। সারাদেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার জন।
চুক্তি অনুযায়ী তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের মধ্যে এখন পর্যন্ত দুই দফা চালানে ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ। মার্চ মাসের ভ্যাকসিনের চালান আসেনি, এপ্রিলের চালান নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া, ভারতে কোভিড রোগী অনেক বেড়ে যাওয়া ও ভ্যাকসিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট হচ্ছে।
গতকাল বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশের কাছে ভ্যাকসিনের মজুত ছিল ২৭ লাখের কিছু বেশি। এখন প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। এ হারে ভ্যাকসিন দেওয়া চলতে থাকলে আগামী ১৮-২০ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন ফুরিয়ে যাবে।
এরইমধ্যে ভ্যাকসিনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেক্সিমকোকে তিন দফা তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউটকেও চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের একটি উৎসের ওপর নির্ভর করায় সংকটে পরতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল কোনো একটি ভ্যাকসিনের জন্য কাজ না করে একাধিক উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার। ভ্যাকসিন দ্রুত পেতে অগ্রিম টাকা জমা দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি।
কিন্তু সরকার শুধু অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন আমদানি করেছে। চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে ট্রায়ালে আগ্রহী থাকলেও বাংলাদেশের সিদ্ধান্তহীনতায় তা আর হয়নি।
যেসব দেশে ভ্যাকসিন রোল আউট করা হচ্ছে সব দেশেই একাধিক ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। এমনকি ভারতেও অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের পাশাপাশি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাশিয়ার উৎপাদিত স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে ভারত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুরু থেকেই আমরা একাধিক উৎস থেকে ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দিয়ে এসেছি। কিন্তু তারপরও একটি মাত্র উৎসের ওপরই সরকার নির্ভর করে ছিল। তবে এখনো এ সংকট কাটিয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। এখন দেশের বেসরকারি যে দুটি ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট আছে সেগুলো সরকার যেন দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভাড়া নিয়ে রাশিয়ার ভ্যাকসিন উৎপাদন করে। এছাড়া সরকারের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের যে ভ্যাকসিন উৎপাদন প্ল্যান্ট রয়েছে তা আধুনিকায়ন করতে হবে।
অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, 'এখন প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন আপাতত বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ প্রথম ডোজ যাদের দেয়া হয়েছে তাদের সবাইকে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। তবে একটি স্বস্তির বিষয় হলো প্রথম ডোজ নেয়ার ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেয়া যাবে। তাই আমাদের হাতে এখনো ২/৩ মাস সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সেরামের বাইরে অন্য যেসব দেশে অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হচ্ছে সেখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে হবে'।
সরকার এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বাইরে অন্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির ভ্যাকসিনের প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রস্তাবকৃত কোম্পানিগুলোার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দিলে সরকার ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশে 'স্পুটনিক ফাইভ' ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "রাশিয়ার সঙ্গে ভ্যাকসিনের যৌথ-উৎপাদনের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি…যদিও এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি"।
তিনি জানান, প্রস্তাবনা অনুযায়ী রাশিয়া বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন তৈরির প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে ও বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে।
"যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, দামও কম হবে, সবকিছু ভালোর দিকেই এগোবে," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ভ্যাকসিনের সংকট অবশ্যই আছে। তবে আমরা এখনো বিশ্বাস করি ভ্যাকসিন আমরা পাবো। ভ্যাকসিনের যদি আর একটি চালানও আসে তাহলেও আর কোন দুশ্চিন্তা থাকে না। সেরাম থেকে ভ্যাকসিন আনার জন্য সরকার সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছে'।
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, 'প্রথম ডোজ বন্ধের এখন পর্যন্ত কোন পরিকল্পনা নেই। কোভ্যাক্স থেকেও আমরা ভ্যাকসিন পাবো। অন্য আরো উৎস থেকে ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি সাপ্লাই চেইন অব্যাহত থাকবে আর ভ্যাকসিনের যে কর্মযজ্ঞ তা বছরব্যাপী অব্যাহত থাকবে'।
উল্লেখ্য, দুই বছরের মধ্যে দেশের ১৪ কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।