ভেড়ার পশমে তৈরি কম্বলের ঐতিহ্য কি হারিয়ে যাবে?
বিশেষ ধরনের কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া হচ্ছে ভেড়ার পশম। এরপর চলছে একই রঙের পশমগুলো বাছাই করার কাজ। পানিতে ভালো করে ধোয়ার পর নেওয়া হবে তুলা বানানোর প্রস্তুতি। পরবর্তীতে পশম শুকিয়ে ধুনাই করে বানানো হবে তুলা। সেই তুলা চরকায় কেটে সুতা তৈরি করা হবে। পরিশেষে, হস্তচালিত তাঁতে বুনে বানানো হবে কম্বল। বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করার পর কম্বলটি ব্যবহার উপযোগী হবে।
হাতে বোনা কম্বল তৈরির এই অসাধারণ কাজটিই করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়াগোলা মহল্লার ৬৫ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। ভেড়ার লোমের তৈরি এই কম্বল বেশ গরম হওয়ায় শীত নিবারণে অত্যন্ত কার্যকরী।
নামকরা বিপণিবিতান থেকে শুরু করে দেশব্যাপী সর্বত্র এই কম্বলের চাহিদা আছে। আব্দুল খালেকের দাবি, সারা দেশে একমাত্র তিনিই ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করে থাকেন। তবে পৈত্রিকভাবে পাওয়া এই পেশা তিনি ধরে রাখলেও তার সন্তানরা কেউ এই পেশায় আসেননি। বৃদ্ধ আব্দুল খালেকের আশঙ্কা তার মৃত্যুর পর এই পেশায় আর কাউকে পাওয়া যাবে না।
আব্দুল খালেক জানান, তারা বংশ পরম্পরায় ভেড়ার লোম কাটেন। এর আগে তার দাদা, দাদার বাবা এবং তার নিজের বাবা এই পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তাদেরকে গাড়লী বলা হয়। তিনিও খুব ছোটবেলা থেকেই এই পেশার সাথে যুক্ত। তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে কম্বল বানাচ্ছেন। তবে তার দুই ছেলের কেউ এই পেশায় আসেননি। বড় ছেলের আছে পুরনো বইয়ের ব্যবসা। অন্যদিকে, ছোট ছেলে মোটর মেকানিক ও তেলবাহী লরীর চালক।
আব্দুল খালেক জানান, "আমি গ্রীষ্মের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ভেড়ার লোম কেটে আনি। প্রতিটি ভেড়ার লোম কেটে দেওয়ার জন্য ৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। কেউ কেউ আবার পশম কেটে দেওয়ার জন্য ১০০ টাকা করেও দেন।"
আগে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি ভেড়ার লোম কাটতে পারলেও এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ২০ থেকে ৩০টির বেশি ভেড়ার লোম কাটতে পারেন না আব্দুল খালেক। অনেক সময় সরকারি আহ্বানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পালিত ভেড়ার লোমও কেটে দিয়ে আসেন তিনি। লোম কাটার পর সেই লোম দিয়েই তৈরি করেন কম্বল।
আব্দুল খালেক জানান, এই শীতে মাত্র দেড় মাসে তিনি ২০টি কম্বল তৈরি করে বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কম্বল বিক্রি করেছেন তিন হাজার টাকায়। একটি কম্বল তৈরি করতে তার পাঁচদিন সময় লাগে।
তিনি আরও জানান, একটি কম্বল তৈরি করতে ১২টি ভেড়ার পশম লাগে। ১২ টি ভেড়া থেকে প্রায় চার কেজি পশম পাওয়া যায়। সেই পশম পানিতে ধুয়ে শুকানো হলে মাত্র দুই কেজি অবশিষ্ট থাকে। দুই কেজি লোম ধুনে তুলা তৈরি করা হয়। এরপর চরকায় কেটে তুলা থেকে সুতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে, সুতা থেকে হস্তচালিত তাঁতে বুনে কম্বল তৈরি শুরু হয়। একটি কম্বল সাধারণত সোয়া তিন হাত চওড়া ও পাঁচ হাত লম্বা হয়।
আব্দুল খালেক জানান, তাঁতে কম্বল বোনার পর সেটা গরম পানিতে সাড়ে তিন ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর কম্বলগুলো তিনি রোদে শুকান। পরিশেষে তা ব্যবহার উপযোগী হয়। গরম পানিতে ভিজিয়ে শুকানো হলে সুতাগুলো বেশি টাইট হয় এবং কম্বলের বাইরের লোমগুলো ঝরে পড়ে যায় বলেও জানান তিনি।
শুরুতে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় ফেরি করে কম্বল বিক্রি করতেন আব্দুল খালেক। ভেড়ার লোমের কম্বল হওয়ায় চাহিদাও ছিলো প্রচুর। এসব এলাকায় প্রচুর ঠান্ডা পড়ে। ভেড়ার তৈরি কম্বলের উষ্ণতা বেশি হওয়ায় এসব অঞ্চলের মানুষ কিনতোও বেশি।
খালেক বলেন, "তখন প্রতিমাসে একেকটা কম্বল আড়াইশো টাকা করেও বিক্রি করেছি। এরপর আড়ং, অরণ্য ও হ্যান্ড টাচের কাছেও প্রচুর কম্বল বিক্রি করেছি। এখন আর এদের দিতে পারি না। যে কয়টা তৈরি করি ক্রেতারা বাসা থেকেই এসে নিয়ে যায়। দেশের বিভিন্নস্থানের মানুষ আমার তৈরি কম্বল ব্যবহার করছে। কম্বল ব্যবহার করে আরাম পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তারা।"
তিনি আরও বলেন, " ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেড়ার লোম কাটার জন্য একবার দুই মাস থাকতে হয়েছিলো। তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। আমি সেই ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি করে শেখ সাহবকে (শেখ মুজিবর রহমানকে) দিয়েছিলাম।"
"বংশ পরম্পরায় এই পেশা চলে আসলেও আমার পূর্বপুরুষ তেমন নকশা জানতো না। আমি বিভিন্ন ধরনের নকশা শিখেছিলাম আমার গুরু সীতেশ বাবুর কাছ থেকে। তিনি রাজশাহী শহরের ভেড়ীপাড়া এলাকায় থাকতেন। তিনিও মারা গেছেন," বলেন খালেক।
দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "এই পেশায় আর কেউ থাকলো না। আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় আমিও তেমন কাজ করতে পারিনা। এই শিল্পকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়নচন্দ্রকে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছিলাম। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও কাউকে অন্তত শেখানো যেত।"
আব্দুল খালেক জানান, "আমার তৈরি কম্বল ঢাকার হ্যান্ড টাচের সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়াতেও গেছে। সেখান থেকে আমাকে ডিজাইন পাঠিয়ে তৈরির কথাও বলা হয়েছিলো কিন্তু শরীরে আর না কুলাতে তৈরি করতে পারিনি।"
১১ ফেব্রুয়ারি তার তৈরিকৃত কম্বল দেখিয়ে আব্দুল খালেক বলেন, এই কম্বল প্রাণ কোম্পানির এক কর্মকর্তা এক মাস আগে অর্ডার দিয়েছিলেন।
এবছর শীতে তিনটি কম্বল ক্রয় করেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত আরিফুল ইসলাম। কম্বল তিনটি ক্রয় করে একটি উপহার পাঠিয়েছেন দিনাজপুরের একজন চিকিৎসককে। বাকি দুটি পাঠিয়েছেন তার কোম্পানির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তাকে।
আরিফুল ইসলাম জানান, ভেড়ার লোম থেকে কম্বল তৈরির গল্প বলাতে তারা অর্ডার দিয়েছিলেন। এখন ভালোভাবেই ব্যবহার করছেন সেই কম্বল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ভেড়ার খামার বেশি থাকায় আব্দুল খালেকের জন্য কম্বল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। অনেক কম্বল তৈরি করেছেন তিনি। তবে এখন বয়েস হয়ে যাওয়ায় খুব একটা তৈরি করতে পারেন না। শুধু অর্ডারের কাজগুলোই করেন।
আব্দুল খালেকের তৈরি ভেড়ার লোমের কম্বল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্রকেও উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
আব্দুল খালেকের সন্তানদের কেউ এই পেশায় না আসায় তার আফসোস রয়েই যাবে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।