ভারত-বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টিতে আন্তঃসীমান্ত নদী পর্যটন গুরূত্বপূর্ণ: বিশেষজ্ঞ মত
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ করে দিতে পারে আন্তঃসীমান্ত নদী পর্যটন- এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নৌপথে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ও পর্যটন গড়ে তোলা দুই দেশেরই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান কাটস ইন্টারন্যাশনাল-এর নির্বাহী পরিচালক বিপুল চ্যাটার্জি।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী পর্যটন নিয়ে কাটস ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
এছাড়াও, দুই দেশের স্থানীয় গোষ্ঠীর উন্নয়নে এবং পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, "আমরা যদি ৩ টি বিষয়ের উপর জোর দেই, তাহলে এই নদীভিত্তিক টেকসই আন্তঃসীমান্ত পর্যটন খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব হবে। আর এই তিনটি বিষয় হলো- অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সহজ ও সঠিক নিয়ম-নীতি এবং জনসচেতনতা।"
'দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহ' শীর্ষক এক আঞ্চলিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এই ওয়েবিনারটি আয়োজন করা হয়। দুই দেশের ৭৫ জনেরও বেশি শেয়ারহোল্ডার এই ওয়েবিনারে অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের বিশেষ বক্তব্যে ভারত সরকারের বন্দর মন্ত্রণালয়ের জলপথ ও পরিবহন শাখার অন্তর্ভুক্ত 'অভ্যন্তরীণ জলপথ কর্তৃপক্ষে'র চেয়ারম্যান অমিতা প্রসাদ বলেন, 'মেরিটাইম ইন্ডিয়া ভিশন ২০৩০' এর অংশ হিসেবে ভারত নৌপথে ভ্রমণ যোগাযোগ উন্নত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক।
তিনি আরও বলেন, 'ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটগুলোকে গঙ্গা নদীর তীর দিয়ে পর্যটন স্থানগুলোকে যুক্ত করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীসমূহ, যেগুলো ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে।'
অমিতা প্রসাদ আরও জানান, ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে উপকূলীয় ও প্রটোকল রুটগুলো দিয়ে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর' চালু করার চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এখন পর্যন্ত প্রটোকল রুট দিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতার মধ্যে দুটি নৌযান চলাচল করেছে।
নৌপথে পর্যটনের ফলে দুই দেশেরই স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বলে মনে করছেন তিনি। কারণ জাহাজের ক্রু, জেটি অপারেটর, অনুবাদক, স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড, স্থানীয় শিল্পী, ছোট ছোট নৌকার অপারেটর-এর মত নানাবিধ চাকরির সুযোগ এখানে তৈরি হবে।
তবে এসব সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যাত্রী ও ক্রুদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া, শুল্ক বিভাগের ছাড়পত্র পাওয়া ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ছাড়পত্র পাওয়ার নিয়মকানুন ও প্রক্রিয়া সামান্য শিথিল করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
ড. প্রসাদ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোলাম সাদেক বলেন, বিশ্বের একটি অদ্বিতীয় বদ্বীপ হওয়ায় এখানে নৌ পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সুযোগ রয়েছে।
সাদেক বলেন, 'বিধিনিষেধ সম্পর্কিত বিষয়গুলো ইতোমধ্যেই কিছুটা সমাধান করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বেসরকারি খাতের উচিৎ কোভিড-১৯ সংকট শেষ হওয়া মাত্রই নৌ পর্যটন নিয়ে বড় পরিসরে কাজ শুরু করা ও বাজার তৈরি করা,'
'নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যটকদের আকর্ষণ রয়েছে। নদীতে ভাসমান মানুষদের জীবনযাত্রা কিংবা বর্ষায় ইলিশ ধরার জন্য জড়ো হওয়া-সব মিলিয়েই নৌ পর্যটন একটি অসাধারণ ব্যাপার,' বলেন তিনি।
জার্নি প্লাস, বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমানের মতে, 'কোভিড-১৯ মহামারি পর্যটন খাতকে প্রচন্ড মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখন টিকে থাকার একমাত্র উপায় হিসেবে আছে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ছোটখাটো আন্তঃসীমান্ত পর্যটন,'
তিনি বলেন, 'একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এই পর্যটন শুধুমাত্র নৌবিহারেই সীমাবদ্ধ নয়, মানুষ এই অঞ্চলের আশেপাশের পরিবেশ, ঐতিহাসিক স্থান ও সংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবনযাত্রাও দেখতে চায়।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এম/এস হেরিটেজ রিভার ক্রুইজ প্রাইভেট লিমিটেড-এর পরিচালক রাজ সিং বলেন, 'স্থানীয় গোষ্ঠীর জন্য নৌ পর্যটন সবচেয়ে বেশি সুফল বয়ে আনতে সক্ষম। যেসব স্থানে সড়কপথে যাওয়া যায়না, সেখানে নৌবিহারে যাওয়া সম্ভব। এর ফলে লোক শিল্পকলা ও নারীসহ অন্য শিল্পীরা নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের সুযোগ পাবেন,'
তবে মহামারির কারণে এসব রুটে বর্তমানে চলাচলের সুযোগ সীমিত বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
টেকসই নৌ পর্যটনের জন্য তিনি আধুনিক জেটি, টেকসই ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত জাহাজ, শব্দদূষণ মুক্ত সাইলেন্সার, অয়েল সেপারেটর ও দূষণমুক্ত নদীতীর গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে আসামের স্টেট ইনফরমেশন কমিশনার সমুদ্র গুপ্ত কাশ্যপ বলেন, উত্তরপূর্ব ভারতের বেশিরভাগ পুরনো শহরই ছিল নদীভিত্তিক।
গণমাধ্যম ও নতুন প্রজন্মের ভ্রমণ লেখকদের সঙ্গে অংশীদারত্ব তৈরি করলে তারা ব্রক্ষ্মপুত্রের নানাবিধ দিক নিয়ে চমৎকার উপস্থাপনা করতে পারবে এবং এতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে বলে জানান তিনি।
ভারতীয় চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ফেডারেশন-এর উত্তরপূর্ব উপদেষ্টা পরিষদের পরিচালক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, 'নৌ পর্যটন একটি উপযুক্ত খাত, এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা একে কীভাবে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ সুবিধা আনতে পারবো?'
- সূত্র: নর্থইস্ট নাও