বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের ৬১% ঋণগ্রস্ত, ৬০% বেকার: গবেষণা

বাংলাদেশ

টিবিএস রিপোর্ট 
28 September, 2021, 12:00 am
Last modified: 28 September, 2021, 12:43 am
দেশে ফেরত আসা প্রতি ৩ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ১ জনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অবনতি হয়েছে এবং তাদের সিংহভাগই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন

বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের ৬০ শতাংশ বর্তমানে বেকার, ৬৫ শতাংশের নিয়মিত মাসিক কোন আয় নেই, ৬১ শতাংশ এখনও ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। 

এসব নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরম অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-(বিলস) এর "দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা"- শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে এবং ৮৭ শতাংশ দেশে এসেও মানসিক অসুস্থতার কোন চিকিৎসা পায়নি। ৭৫ শতাংশের কোন সঞ্চয় নেই, ৭৩ শতাংশ  তাদের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং ৩৮ শতাংশ নারীকে সমাজে নিম্ন শ্রেণীর চরিত্রহীন নারী বলে গণ্য করা হয়।

সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিলস সেমিনার হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বিলস দেশের তিনটি জেলার (চট্টগ্রাম, যশোর এবং ফরিদপুর) ৩২৩ জন প্রত্যাবাসী অভিবাসী নারী শ্রমিকের উপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। গত ২০২০ এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর এ গবেষণাটি সম্পন্ন হয়।

গবেষণার একটি কেস স্টাডি ছিল চট্টগ্রামের ফরিদা বেগমের (ছদ্মনাম)। সামাজিক গঞ্জনা ও দুর্ব্যবহারে দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছেন চট্টগ্রামের প্রত্যাবাসী কর্মী ফরিদা বেগম। তিনি এক বছর জর্ডানে ছিলেন, যেখানে বন্দী রেখে তাঁর ওপর নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়, দেওয়া হতো না খাবারও। একসময় প্রাণ বাচাতেঁ ফরিদাসহ তাঁর সঙ্গে বন্দী আরও দুই নারী পাশের একটি তিনতলা ভবনের ছাদে লাফিয়ে কোনরকমে পালাতে সফল হন। 

কিন্তু, লাফ দেওয়ার পর আঘাত লেগে তাঁর স্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, চলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাংলাদেশ মিশনের সাহায্যে ফরিদা দেশে ফিরে আসেন, কিন্তু স্বামী তাঁকে ঘরে তোলেনি। ফরিদা জানান, আমার স্বামী বলে "অন্য কোন মেয়ে হলে লজ্জায় মরে যেতো, তুই কেন বেঁচে আছিস?" তাই এখন থাকতে হচ্ছে বাপের বাড়িতে। সেখানে ভাইবোনেরাও তাঁর সাথে কথা বলে না। খুব জরুরি দরকার ছাড়া, বাড়ির বাইরেও যান না ফরিদা। পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই ঘৃণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখে বর্বরতার শিকার ফরিদাকেই।    

ফরিদা বলেন, গত রমজানে আমাকে কেউ সাহায্য দেয়নি, কুরবানি ঈদেও গোশত দেয়নি। সবাই বলে, "দরকার হলে কুকুরকে খাওয়াব, তাও তোকে এক টুকরোও দেব না। তাতে কোনো সওয়াব হবে না!"

প্রতিদিন এমন অপমানের শিকার হয়ে মাঝেমধ্যেই এখন আত্মহত্যার কথা ভাবেন ফরিদা। এই অবস্থায় দেশের বাইরে যাওয়াই তাঁর একমাত্র মুক্তির উপায় বলে মনে করেন ফরিদা। 

"জানিনা এভাবে কীভাবে বাঁচব, আরেকবার বিদেশ যেতে পারলে হয়তো, সবকিছু সামলে ওঠা যাবে," বিলস গবেষকদের  জানিয়েছেন ফরিদা।     

গবেষণা উপ-পরিচালক মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, "পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে ২৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরেছেন, ১৮ শতাংশ এক বছরের সামান্য বেশি সময় থেকেছেন, ৫৫ শতাংশেরদেশে ফেরত আসা ছিল জবরদস্তিমূলক।"

তিনি আরো বলেন, দেশে ফেরত আসা প্রতি ৩ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে ১ জনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অবনতি হয়েছে এবং তাদের সিংহভাগই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৮৫ শতাংশ তাদের বর্তমান কাজ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত এবং ৫৭ শতাংশ তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে চিন্তিত।

যশোর ফেরত এক প্রবাসী নারীর কন্যা চম্পা বলেন, "আমার মা দেশের বাইরে যাওয়ার আগে আমাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। এখন খুবই দুঃসময়, কখনো খাই, কখনোবা না খেয়ে থাকতে হয়।" 

ফরিদপুরের মমতাজ নামের এক বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকের মা বলেন, "আমার মেয়ে খুবই অসুস্থ। বিদেশে থাকার সময় ওকে দেশে কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। না খাইয়ে রাখা হয়, এভাবে কিছুদিন চলার পর সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।"  

গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে  যাওয়া ৫২ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়, ৬১ শতাংশ খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন, ৭ শতাংশ যৌন এবং ৩৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাটির পরিচালক নাজমা ইয়ামিন বলেন, "বর্তমানে বেশিরভাগেরই পরিবার বা সমাজে মতামতের কোন মূল্য নেই। তাদের কেউ গ্রাহ্য করে না।কেউ বিশ্বাস করে না। বিদেশ থেকে ফেরার সময় পরিবারের সদস্য দ্বারা বিমানবন্দরেই অযাচিত আচরণের শিকার হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী শ্রমিক। ১৫ শতাংশ বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারী তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ১১ শতাংশ নারী শ্রমিকের স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং ২৮ শতাংশ দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছেন।"  

তবে ব্যাপক নিপীড়ন-নিযাতন সহ্য করেও কিছু কিছু বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিক তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাদেরই একজন যশোরের নিলুফার বেগম বলেছেন, "সেখানে অনেক সমস্যার মুখে পড়েছি। ছোটখাটো ভুল হলেই আমার চাকরিদাতা মারপিট করতো। তাই সেখান থেকে পালিয়ে যাই, কিন্তু আমার দরকারি সব কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিদেশে থাকা দেশের মানুষও একবার আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। কিন্তু আমি আশা হারাইনি, আমার সংকল্প ছিল- নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা না বদলে দেশে ফিরব না।" 

এনিয়ে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, বিদেশে সবচেয়ে বেশি শারীরিক, মানসিক এবং যৌন সহিংসতার শিকার হয় নারী গৃহকর্মীরা, যার সিংহভাগই ঘটে মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ সমস্ত দেশকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও'র আইন আনুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা।  

বিলস নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাকিল আখতার চৌধুরী বলেন, এসমস্ত কত নারী শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে এবং ফেরত আসছে- তার সঠিক হিসেব নেই। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও দেশি-আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অনেক দায় রয়েছে।

।।

BILS Executive Council Member Shakil Akhter Chowdhury said, "There are no accurate statistics on how many women workers are going abroad and returning. However, the government and international law have a responsibility to rehabilitate all these affected female migrant returnees."

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.