বায়ু দূষণসহ নানা ঝুঁকির মুখে নিম্ন-আয়ের বস্তিবাসী: গবেষণা প্রতিবেদন
ঢাকার দুই প্রান্তিক ঘনবসতিপূর্ণ নিম্ন-আয়ের এলাকায় বায়ু অংশের ঘনত্ব ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত বৈশ্বিক মানের চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। ফলে, বাসিন্দারা বায়ু দূষণজনিত রোগ, যেমন- লেরেঞ্জিয়াল সমস্যা, হাঁপানি এবং শ্বাসনালীর সমস্যায় ভুগছেন।
আজ বুধবার সকালে প্রকাশিত "আরবান লোকালাইজড পল্যুশন ইন দ্য কন্টেক্সট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ" শীর্ষক একটি গবেষণা ফলাফল থেকে এমন তথ্য জানা যায়। এক ভার্চুয়াল অনষ্ঠানে এই গবেষণা ফলাফল প্রকাশ ও আলোচনা করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন মতে, ঘরের ভিতর বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হলো রান্নার জন্য ব্যবহৃত মাটির চুলা এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত বায়োম্যাস। রান্না করার সময় দীর্ঘ সময় ধরে ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার কারণে নারীরা বায়ু দূষণে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন।
ঢাকার প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, আভ্যন্তরীন বায়ু দূষণ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত চিত্র নিরূপণে ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি)-এর দুইটি বৃহৎ বস্তি এলাকা, ধলপুর সিটিপল্লী বস্তি এবং ঢাকা ম্যাচ কলোনি, শ্যামপুর-এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই দুই নিম্ন-আয়ের বসতি বিভিন্ন বায়ু দূষণকারী কলকারখানা যেমন- স্টিলের মিল, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, মেলামাইন ফ্যাক্টরি, ইট ভাটা ইত্যাদি দ্বারা বেষ্টিত।
গবেষণাটি পরিচালিত হয়, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল ইনিশিয়েটিভ (বিওয়াইইআই) এবং পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টার (পিএসটিসি) কর্তৃক বাস্তবায়িত 'দ্য ফিচার গ্রিন আর্থ' প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পটি বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) ডিপার্টমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) এর সাথে একত্রে গবেষণাটি পরিচালিত করে। ২০২০ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত গুণগত ও পরিমাণগত তথ্য নিয়ে মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করে এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন, বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আফসানা হক এবং আইসিসিসিএড-এর সমন্বয়ক সরদার শফিকুল আলম।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আফসানা হক বলেন, ঢাকায় প্রায় ৫০০০ বস্তি রয়েছে যেখানে ৪ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করেন। জীবন ধারণে মৌলিক সুবিধাগুলো পাওয়া যেখানে বিরাট চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের বাস্তবতাকে করে তুলেছে আরো জটিল।
গবেষণার অংশ হিসেবে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পল্যুশন স্টাডিজ(ক্যাপস) গবেষণা এলাকার পানি ও বায়ু পরীক্ষা করেন। বায়ু পরীক্ষায় দেখা গেছে, ধলপুরে বায়ূর ঘনত্ব পি.এম ১১৬.৯৬ µg/m3 ও পি.এম ১৬৪.৭১ µg/m3, এবং ঢাকা ম্যাচ কলোনিতে পি.এম ৮৩.৯৬ µg/m3 ও পি.এম ১৫৫.৫০ µg/m3। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত মান পি.এম ২.৫ µg/m3 এবং পি.এম ১০ µg/m3।
পানি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে যে, উভয় গবেষণা এলাকার নমুনা পানিই বিদেশী কণা দ্বারা দূষিত হয়ে মানদণ্ডের মাত্রা অতিক্রম করেছে। নমুনা পরীক্ষায় ই. কোলি (৭ কিংবা তার বেশি) এবং মোট কোলিফর্মের অগণিত কলোনির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। গবেষণা এলাকায় বায়োলজিকাল অক্সিজেন ডিমান্ড এবং ক্লোরিন কনসেন্ট্রেশনের পরিমাণও অতিরিক্ত পাওয়া গেছে।
গবেষণা এলাকায় বসবাসরত স্থানীয়রা দীর্ঘসময় ধরেই একাধিক পানি-সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন- দূরবর্তী পানির উৎস, পানির সংকট এবং নিম্ন মান। তারা পানির সরবরাহের সাথে জড়িত নানা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। গবেষণা এলাকা দুটিতে, পানির উৎস এবং সরবরাহ হয় সাপ্লাই লাইন এবং ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে। কিন্তু পানির সরবরাহ থাকে অল্প সময়ের জন্য এবং প্রায়ই তা বিঘ্নিত হয়। অধিকাংশ নারীদের পানি সংগ্রহের জন্য ৫ থেকে ১০ মিনিট পথ হাঁটতে হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় পানি সংগ্রহের জন্য। প্রতি মাসে প্রতিটি বসতবাড়ি গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা বিল দিলেও মেলে না যথাযথ মানের পানি।
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি পরিবারের জন্য অন্তত একটি স্যানিটারি টয়লেট থাকতে হবে। তবে, বাংলাদেশ সরকারের মতে, সর্বাধিক দুইটি পরিবারের (অথবা ১০ জন ব্যক্তি) জন্য একটি ল্যাট্রিন সাপেক্ষে পরিবারগুলি "শেয়ারড ল্যাট্রিন" বা "কমিউনিটি ল্যাট্রিন" ব্যবহার করতে। তবে, উভয় বস্তিতেই একটি টয়লেট শেয়ার করা পরিবারের সংখ্যা সবদিক থেকেই নির্ধারিত 'বেসিক মিনিমাম সার্ভিস লেভেল (বিএসএমএল)' থেকে অনেক উপরে। গড়ে একটি টয়লেট ৩ বা ৪টি পরিবার (১৫-২০ জন মানুষ) ব্যবহার করে। দূরবর্তী অবস্থান, ডিজাইন এবং টয়লেট শেয়ারের ফলে নিম্ন স্যানিটেশন সুবিধা, নারীদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বড় চিন্তার বিষয়, বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
গবেষণা প্রকাশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। এইসকল অর্জনের বিপরীতে যেসকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সচেতনতাকে এই চ্যালেঞ্জের মূল হাতিয়ার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাশন, পানি সরবরাহ এবং পানি ও বায়ু দূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন-সকল খাতকে একত্রে কাজ করতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, শহরে কতজন মানুষ বসবাস করতে পারবে সেই সংখ্যা আগে নির্ধারণ জরুরি। তার পাশাপাশি বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। শহরের পাশাপাশি অন্যান্য এলাকায় জীবনমান উন্নয়নও জরুরি। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে, যদিও এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া কিন্তু এই বিষয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন। সকল আয়ের শ্রেণীপেশার মানুষের জন্য সেবামূল্যে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে সমতা নিশ্চিত জরুরি। পরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন নিশ্চিতে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে রিসাইকেল ও পুনর্ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করতে হবে, সরকার ইতোমধ্যে বর্জ্য দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে নিজেদের সংকটের কথা সকলের সামনে তুলে ধরেন ধলপুর এবং ম্যাচ কলোনিবাসী ইসমাইল হোসেন, মোসাম্মত পারভি এবং রিমু। তারা তাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের কমিউনিটিতে বিদ্যমান পানি সংকট, বায়ু দূষণ, বর্জ্য নিষ্কাশন সম্পর্কিত জটিলতা এবং এসকল বিষয়ে তাদের জীবনের উপর প্রভাবের কথা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। সঞ্চালনা করেন, পিএসটিসি-র নির্বাহী পরিচালক ড. নূর মোহাম্মদ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাজুকের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা জাহান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ এবং বুয়েটের প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান।
আরো উপস্থিত ছিলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন পরিচালক আফরোজ মহল, প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানিক কুমার সাহা, আইসিসিসিএডি এর পরিচালক অধ্যাপক সলিমুল হক এবং বুয়েটের ইউআরপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন হাসান।
অধ্যাপক সলিমুল হক বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নগরায়ণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই জটিল সমস্যার কোন একক সমাধান নেই। একাধিক সমাধানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আফরোজ মহল জানান, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর দ্রুততম বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর একটি। ধারণা করা হয়, ২০৩০ এর মধ্যেই দেশের জনসংখ্যায় ৪৪ শতাংশ শহরের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদের অধিকাংশই বাস করবে ঢাকায়। এসকল অধিবাসীদের অধিকাংশই প্রায়শ পতিত হন প্রান্তিক স্বল্প আয়ের এলাকায়, যেখানে নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যকর পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আলো-বাতাসপূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর আবাসের মত মৌলিক সেবাসমূহ অপ্রতুল। এমনকি, যেখানে সেবা আছে সেখানেও গুণমান, সাশ্রয়িতা এবং নির্ভরযোগ্যতা যথাযথভাবে বজায় রাখা হয় না। আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে সমস্যাগুলি আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নগরভিত্তিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে যুব সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করছে, যেন তারা পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠে এবং স্থানীয় সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এই গবেষণার মূল কারণ, শহুরে পরিবেশে সুনির্দিষ্টভবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবগুলো কী কী।
পরিচালিত গবেষণায় উন্নত ভবিষ্যত নিশ্চিতে টেকসই পরিবেশের জন্য কাজ করতে যুবসমাজের আকাঙ্ক্ষাও অনুভব করেছেন গবেষকরা। এই বিপদাপন্ন সম্প্রদায়ের যুব প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অনুপ্রেরণার সাহায্যে সম্পদে পরিণত করা যেতে পারে। নীতিনির্ধারক, বিনিয়োগকারী, গবেষক এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যবধান পূরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক, জাতীয় ও স্থানীয় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।
মানিক সাহা তার উপস্থাপনায় জানান, ২০১৮ সাল থেকে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল ইনিশিয়েটিভ (বিওয়াইইআই) এবং পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেইনিং সেন্টার (পিএসটিসি) যৌথভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে 'দ্য ফিচার গ্রিন আর্থ' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায় আর্থ ক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পটি একটি শক্তিশালী পরিবেশবাদী আন্দোলন গড়ে তুলছে।