বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা
১১ বছর বয়সী মেয়ে ইশা আক্তারকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুর থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালের অ্যাজমা সেন্টারে এসেছিলেন তার বাবা মো. হারুন ইসলাম। কয়েকদিন থেকেই কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ইশা। ধূলোর কারণে মাস্ক পরে স্কুলে গেলেও তার কাশি ও শ্বাসকষ্ট কমছেনা। তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরা।
বায়ুদূষণ নিয়ে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ঢাকার বাতাসে ধূলোবালি এবং শিল্পকারখানার ধোয়া বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের মান দিনদিন খারাপ হচ্ছে।
তিনি বলেন, বৃষ্টি না হওয়ার ফলেও বাতাদের মান খারাপ হয়। বাতাসের মান খারাপ হলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। সবচেয়ে বেশী স্বাস্থ্যঝুকিতে পড়ে শিশুরা।
এই অধ্যাপক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে তারা ঢাকা শহরের ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাতাসের মানের ওপর পরীক্ষা চালান। সেখানে দেখা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেধে দেওয়া মানের চেয়েও চার থেকে পাচ গুণ বেশী ক্ষতিকর উপাদান ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বাতাসে রয়েছে।
গবেষকরা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৫০ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেন ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কাশি, ছয় শতাংশ অ্যাজমা অথবা শ্বাসকষ্ট এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী মাইগ্রেন অথবা মাথাব্যাথায় ভুগছেন।
পাশাপাশি ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, যাদের আগে কোন ধরণের শ্বাস-প্রশ্বাসগত সমস্যা ছিলো না, তারা এখন স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছেন না।
শিশু রোগীদের জন্য দেশের একমাত্র অ্যাজমা সেন্টার রয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। অ্যাজমা সেন্টারে সম্প্রতি শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে শিশু রোগী বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাজমা সেন্টারের চিকিৎসকেরা।
একই সমস্যায় ভুগছে প্রাপ্তবয়স্করাও
বায়ু দূষণের কারণে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের রোগী বাড়ছে। গত কয়েকদিনে জাতীয় বক্ষব্যাধী ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অ্যাজমা ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিশু ও বয়স্ক রোগী অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাদিয়া সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঋতু পরিবর্তন ও বায়ু দূষণের কারণে অন্যান্য সময়ের তুলনায় গত কয়েকদিন ধরে অ্যাজমা, সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) সহ বিভিন্ন ধরণের শ্বাসতন্ত্রের রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে।
“বায়ু দূষণের কারণে সব বয়সী মানুষের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়েছে। তবে বক্ষব্যাধী হাসপাতালে বয়স্ক রোগী বেশি আসছে।”
এছাড়া যাদের আগে থেকেই অ্যাজমা বা শ্বাসতন্ত্রের কোন সমস্যা আছে দূষণের কারণে এখন সেসব রোগী বেশি খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন বলে জানান ডা. সাদিয়া সুলতানা।
দূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা
কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাসে অতি সুক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার উপরে রয়েছে। ক্ষতিকর বস্তুকণার এ উপস্থিতি না কমে উল্টো বাড়ছে। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এবং ব্যাপক উন্নয়ন কাজের কারণে এ বছর ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা অন্যান্য সময়ের তুলনায় আরো বেড়েছে। বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক (একিউআই) অনুযায়ী সোমবার সকাল আটটায় ঢাকার অবস্থা্ন ছিলো ২৪২, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এ মাসের আটদিন ঢাকা ছিলো সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের জন্য মূলত দায়ী ইটভাটা ও নির্মাণকাজ। ঢাকা মহানগরীর আশপাশে অনেক এলাকায় ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার কারণে বাতাসে সূক্ষ্ম নানা ধরনের ধূলিকণা মিশে যায়। নির্মাণকাজের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে তোলে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য ৫৬ শতাংশ দায়ী ইটভাটা। বায়ু দূষণ কমাতে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মেগা প্রজেক্ট গুলোর ধূলোর দূষণ কমানোর জন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে যানবাহনের ফিটনেস কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া গাছ লাগালে বায়ু দূষণের সঙ্গে কিছুটা যুদ্ধ করা যায়। তাই গাছ লাগাতে হবে।
বায়ু দূষণের কারণে সেসব রোগ হয়
দেশে বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯ এর প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ।
চিকিৎসকেরা জানান, বাতাসের মান ২০০ বেশি হলে মাস্ক পরেও দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা স্বল্প মেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন ধরণের রোগের জন্য দায়ী । এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগ হয়। হাঁপানি রোগী হলে তাদের হাঁপানি বেড়ে যায়। আবার অনেকে নতুন করে হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মার মতো রোগগুলো বায়ুদূষণের কারণে বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যায় নবজাতক ও শিশুদেরও। ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ।”