বাজারে দাম বেশি, সরকারের ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা
বোরো মৌসুমে ধানের ভালো দাম পেয়ে কৃষক খুশি হলেও বিপাকে পড়েছে সরকার। স্থানীয় বাজারে দাম বেশি থাকায় সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে কৃষকের আগ্রহ কম। ফলে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শঙ্কার মধ্যে পড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চলতি মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত দুই লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় দুই মাস ধরে সংগ্রহ কার্যক্রম চললেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার।
অন্যদিকে, সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন চালের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫ লাখ ২২ হাজার টন চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। বর্তমানে সরকারের কাছে ১০ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন চালের মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, সারাদেশে প্রতি মণ মোটা ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা বা তারও বেশি দামে। যেখানে চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২২০ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে, সরকার ১ হাজার ৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা মণ হিসেবে ধান কিনছে।
স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষকরা সরকারের কাছে ধান দিচ্ছেন না। তারা জানান, সরকারের কাছে ধান দিতে গেলে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। সরকারের তরফ থেকে নির্ধারিত আর্দ্রতার কমবেশি বা একটু ময়লা থাকলেও তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এত ঝক্কি সামলানোর চেয়ে স্থানীয় বাজারে ধান বিক্রি করা সহজ বলে মনে করছেন তারা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২১ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১২ জুন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ হয়েছে ৪ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন।
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মাহমুদকাটি গ্রামের কৃষি কার্ডধারী কৃষক নূর ইসলাম বলেন, "১০০ মণের উপরে ধান পাইছি। ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা ধরে ধান বিক্রি করে দিয়েছি। কিছু ধান গোলায় আছে।"
সরকারের কাছে ধান না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "গুদামে ধান দেব না। সরকার যে দাম দিচ্ছে তার থেকে বাজারে মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি পাচ্ছি। তাছাড়া গুদামে গেলে ধান ভিজা, পরিস্কার না; নানা কথা অজুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়। আর ব্যাপারিরা বাড়ি থেকে যেমন তেমন ধান চড়া দামে নিয়ে যাচ্ছে।"
বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের জসিম উদ্দিন জানান, "সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়। তারপর যাচাই বাছাই করে। এর চেয়ে খোলা বাজারে কোন ঝামেলা ছাড়াই বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে।"
যশোরের মণিরামপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, "ধীরগতিতে ধান চাল কেনার কাজ চলছে। খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা গুদামে আসছে না। আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চেষ্টা করছি।"
এদিকে দিনাজপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম সাইফুল ইসলাম বলেন, "স্থানীয় বাজারে দাম বেশি হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে একটা অনীহা দেখা যায়। কারণ এখানে ধান বিক্রি করতে হলে আর্দ্রতা, পরিচ্ছন্নতা সবই দেখা হয়। এটা কৃষকের জন্য টু দ্যা পয়েন্টে মেইনটেইন করা কিছুটা কষ্টকর। যে কারণে ধান সংগ্রহে একটু ধীরগতি আছে।"
তিনি বলেন, প্রায় ২৫ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাড়ে ১৪ হাজার টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এবারে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল, ৩৯ টাকা কেজি দরে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল ও ২৭ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান কেনা হবে। ধান ও চাল সংগ্রহ শেষ হবে আগামী ৩১ আগস্ট।
গত বোরো মৌসুমে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। যদিও তা অর্জন হয়নি। ফলে সরকারকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল।
সরকারের মজুদ তলানিতে নেমে এসেছিল। এই সুযোগে স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। এবার ধানের দাম বেশি হওয়ার কারণে চালের দাম খুব একটা কমেনি। বরং মৌসুমেও দু'দফায় চালের দাম বেড়েছে। যে কারণে এখনো চড়া দামেই চাল কিনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ বিভাগ) মোঃ রায়হানুল কবীর বলেন, 'এখন ক্রয় কার্যক্রম চলছে। শেষ পর্যন্ত কি পরিমাণ ক্রয় করা হয় সেটা আগে দেখতে হবে। তার আগে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কি হবে না তা বলা মুশকিল।'
তিনি বলেন, 'সরকারের ধান কেনার একটা উদ্দেশ্য থাকে, কৃষক যাতে ভালো দাম পায়। এই উদ্দেশ্য কিন্তু সফল, কারণ কৃষক বেশি দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন।'
খাদ্য অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সাধারণ কৃষকের হাতে খুব বেশি ধানের মজুদ নেই। অনেকেই একেবারে মাঠ থেকেই ধান বিক্রি করে দিয়েছে। এখন সরকারকে ধান সংগ্রহ করতে হলে তার বেশিরভাগটাই স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে নিতে হবে। কারণ তারা মৌসুমের শুরুতে ধান কিনে মজুদ গড়েছে।