বাগদাদ পরিবহনে অগ্নিকাণ্ড নাকি ঋণ মওকুফের কৌশল?
২০১৩ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে রুটে ১৫ টি মার্সিডিজ এসি বাস নিয়ে আসে বাগদাদ গ্রুপ। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি তখন এই রুটে এসি বাস চালু করে। ওই সময়কার অত্যাধুনিক এই বাস যাত্রীদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে।
তবে মাত্র চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির পরিবহন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে বাসগুলো অকেজো অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর সিটি গেট এলাকায় গ্যারেজে পড়ে ছিল। এতে ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করা গ্রুপটির কাছে ৫ ব্যাংকের ১৫০ কোটি টাকা পাওনা আটকে যায়।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে বাগদাদ গ্যারেজটিতে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় ১১ টি বাস। যার মধ্যে ১০ বাস সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। মূহুর্তের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত গ্যারেজের ১০ টি বাস পুড়ে যাওয়ার রহস্য এখনো নির্ণয় করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাশ বলেন, এখনো পর্যন্ত গ্যারেজটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত এবং ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
ক্ষতির পরিমাণ এবং সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে নিউটন দাশ বলেন, এই দুটি বিষয় তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে। তদন্ত সাপেক্ষে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি জানান, এরকম অগ্নিকাণ্ডে উপস্থিত ফায়াস সার্ভিসকর্মীরা অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষতি নির্ণয় করতে না পারলে সাধারণত ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের আবেদন সাপেক্ষে তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস। এরপর গঠিত কমিটি ঘটনা তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করে। বাগদাদ পরিবহনের ক্ষেত্রেও তাই করা হবে। শুক্রবার পর্যন্ত বাগদাদ গ্রুপ কোনো আবেদন করেনি বলে জানান তিনি।
অগ্নিকাণ্ড ও ক্ষতির বিষয়ে বাগদাদ গ্রুপের জিএম সোহেল দ্য ইকবাল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গ্যারেজে তাদের প্রতিষ্ঠানের ১১ টি মার্সিডিজ বাস ছিলো। যার মধ্যে ৭ টি সচল ও বাকি ৪টি অচল। আগুনে তাদের ১০ টি বাস সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বাকি একটি বাস আংশিক অংশ পুড়েছে। অগ্নিকাণ্ডে বাগদাদ গ্রুপের কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এই বিষয়ে বৃহষ্পতিবার রাত ৯টায় আকবর শাহ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী আকবর শাহ থানা পুলিশের এস আই মিজানুর রশিদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত এবং ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানায় যায় নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। কারণ বাসগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজে পড়ে ছিল। এতগুলো বাস দীর্ঘদিন গ্যারেজে পড়ে থাকা এবং অগ্নিকাণ্ডে সব বাস পুড়ে যাওয়ায় বিষয়টি গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশ।
তবে বাগদাদ গ্রুপের গ্যারেজে অগ্নিকাণ্ডে ১১ টি বাস পুড়ে যাওয়া ও ২০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবিকে ব্যাংকের ঋণ মওকুফের একটি কৌশল বলে মনে করছেন পাওনাদার ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাগদাদ পরিবহনে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এভিপি ও হেড অব ব্রাঞ্চ (প্রবত্তক শাখা) মোহাম্মদ ওসমান বলেন, পরিবহন খাতে ব্যবসা করতে ২০১৩ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় বাগদাদ গ্রুপ। ব্যাংকের টাকায় বাগদাদ এক্সপ্রেস নামে মার্সেন্ডিজ বাসের ব্যবসা করলেও গেল আট বছরেও ব্যাংকের টাকা শোধ করে নি ফেরদৌস খান আলমগীর। বর্তমানে বাগদাদ গ্রুপের কাছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক প্রবর্তক মোড় শাখার ৩৪ কোটি টাকা পাওনা আটকে রয়েছে। এই পাওনা আদায়ে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সীতাকুন্ড সলিমপুর এলাকার ৬০ শতক জমি নিলামে তুলেও উপযুক্ত দরদাতা পাওয়া যায় নি।
তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সাল থেকে বাগদাদ গ্রুপ রুটে তাদের বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বাসগুলো নগরীর সিটি গেট এলাকার গ্যারেজে রেখে দেয়। দীর্ঘদিন এভাবে পড়ে থাকায় সবগুলো বাস ইতোমধ্যে অকেজো ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে বাসে অগ্নিকাণ্ড ২০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ঋণ মওকুফের একটি কৌশল বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ছাড়াও বাগদাদ গ্রুপের কাছে ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৫০ কোটি, রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৪৬ কোটি, ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখার ১২ কোটি, সোশাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রবাদ শাখার ১১ কোটি টাকাসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের পাওনা আটকে আছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংক এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ (শেখ মুজিব রোড) সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০৩ সালে ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখায় ব্যবসা শুরু করে বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীর। সার আমদানি করতে মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্সের নামে ঋণ নিলেও এই টাকা ব্যবহার করে অন্যান্য খাতে। এতে অন্যান্য খাতে লোকসান হলে ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংক এশিয়ার বর্তমানে সাড়ে ১১ কোটি পাওনা আটকে রয়েছে।
ঋণের টাকা শোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেই ঋণের টাকা এখনো উদ্ধার হয় নি।
রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে এলটিআর, টার্ম লোনসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং। কিন্তু ঋণ গ্রহণের পরপরই কিস্তি পরিশোধে গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ২০১০ সালেই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ব্যাংকটি। যেই মামলায় প্রতিষ্ঠান তিন সহোদর ও কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীর, তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীরকে বিবাদী করা হয়। বর্তমানে বাগদাদ ট্রেডিংয়ের কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা ৪৬ কোটি টাকা।
বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের রাউজানের ফেরদৌস খান আলমগীর। তার পিতা আইয়ুব খান ছিলেন এই অঞ্চলের সারের ডিলার। এক সময় সারের ব্যবসা থেকে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসেন আলমগীর ও তার সহোদর। পরে ফিশিং, আবাসন, পরিবহনসহ আরো কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তারা। এরপর ব্যাংকগুলো থেকে একের পর এক ঋণ সুবিধা নেন। প্রথম দিকে ব্যাংকগুলোর সাথে ভালো ডিলিং করলেও পরে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে বাগদাদ গ্রুপের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফেরদৌস খান আলমগীর এক সময় ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির পরিচালক ছিলেন।